জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্যই তিনি
প্রকাশিতঃ 10:52 am | October 28, 2020

মাহমুদ আহমদ:
বিশ্বনবি ও খাতামান্নাবেঈন হজরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন ইতিহাসের একমাত্র নবী ও রাসুল (সা.), যিনি সমগ্র বিশ্বমানবতার জন্য প্রেরিত হয়েছেন। প্রাচ্য-প্রতীচ্য, সাদা-কালো আর জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে মানবজাতির কল্যাণেই তার আবির্ভাব। যেভাবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ইরশাদ করেন ‘হে মানবমণ্ডলী, আমি তোমাদের সবার জন্য রাসুল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।’ তাই তিনি কোনো অঞ্চলভিত্তিক অথবা কোনো নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর জন্য প্রেরিত হননি বরং মহান সত্তার পক্ষ থেকে সমগ্র বিশ্বমানবতার জন্য দয়ার প্রতীক হিসেবে তাকে ঘোষণা করা হয়েছে।
সেই মহান রাসুলের বিরুদ্ধে কেউ যদি বিকৃতভাবে কিছু উপস্থাপন করে সে ক্ষেত্রে তাকে উন্মাদ বলা ছাড়া আর কি-বা বলা যেতে পারে। কেননা এই উন্মাদদের এমন হীন আচরণে বিশ্বনবির সম্মানে কি সামান্যতম ঘাটতি দেখা দিতে পারে? অবশ্যই না, বরং এতে মুসলিম উম্মাহ মহানবির (সা.) অতুলনীয় জীবনাদর্শ সবার কাছে আরো ভালো করে তুলে ধরার চেষ্টা করবে। অধিক হারে তার প্রতি দরুদ প্রেরণ করবে।
সম্প্রতি ফ্রান্সে বিশ্বনবি ও শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে কটাক্ষ করে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। এরপূর্বে মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা স্যাম বাসিল ও তার কলাকুশলীরা ‘ইনোসেন্স অব মুসলিম’ নামক চলচ্চিত্রে মহানবি হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-কে অত্যন্ত অশালীন ও বিকৃতভাবে বিদ্রুপ করেছিল। এসব ঘটনায় একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে আর এমনটা প্রত্যেক মুসলমানেরই হওয়ার কথা। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।
যেই মহান রাসুলের জন্য আল্লাহ তাআলা এ জগৎ সৃষ্টি করেছেন তার সম্মানের ওপর আঘাত হানবে এমন সাহস কি কারো আছে? বিধর্মীরা যত চেষ্টাই করুক না কেন কিন্তু শ্রেষ্ঠনবির সন্মানে এক চুল পরিমাণও বেঘাত ঘটবে না, কারণ এই মহান নবীর সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা যেখানে এই সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন যে, ‘ওয়া ইন্নাকা লা আলা খুলুকিন আজীম’ অর্থাৎ নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের ওপরে অধিষ্ঠিত’ (সুরা কলম: আয়াত ৪)। তাই যারা এমন গর্হিত কাজে জড়িত তারা ইসলামের কোন ক্ষতি করতে পারবে না বরং তারা নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের দেখা উচিৎ, মহানবিকে (সা.) যারা কটাক্ষ করার চেষ্টা করে এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তারা কোন পর্যায়ের ব্যক্তি। আমরা যদি ক্ষতিয়ে দেখি তাহলে দেখব এই ধরনের লোকদের কোন ধর্ম নেই এবং তাদের চরিত্রও ঠিক নেই। কেননা কোন ভাল চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তি, সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন তারা এমন কাজ করতে পারে না।
দেখা যায় মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা স্যাম বাসিল ও তার কলাকুশলীরা মূলত অশ্লিল ও নগ্ন ছবি নির্মাণ করে থাকে, এদের মত লম্পটদের কথায় কি ইসলাম কলঙ্কিত হয়ে যাবে? মহানবির (সা.) সম্মানের হানি হবে? অবশ্যই তা কখনো হতে পারে না। কেননা ইসলামই কেবল একমাত্র পরিপূর্ণ ধর্ম। তবে আমরা এ ধরনের গর্হিত কাজের তীব্র নিন্দা জানাই এবং আল্লাহপাকের দরবারে তাদের হেদায়েতের জন্য দোয়া করি। যখন কেউ ইসলামের অবমাননা, কুরআনের অবমাননা এবং রাসুলের (সা.) অবমাননা করবে এর প্রতিবাদ আমরা অবশ্যই করব। তবে আমাদের প্রতিবাদের ধরন হবে শ্রেষ্ঠনবীর অনুপম আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়ে। কোন দেশের পতাকা পুড়িয়ে বা কোন দেশের রাষ্ট্রদূতের ওপর হামলা চালিয়ে বা কাউকে হত্যা করে অথবা অগ্নিসংযোগ ও অপহরণ করে এর প্রতিবাদ আমরা করব না। কারণ এগুলোর কোনটাই ইসলাম ও বিশ্বনবি আমাদেরকে অনুমতি দেয় না।
আমাদের প্রতিবাদের ধরন হবে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য, কুরআনের অনিন্দ্য সুন্দর শিক্ষা এবং বিশ্বনবির (সা.) অতুলনীয় আদর্শ সারা বিশ্বের মাঝে ফুটিয়ে তোলা। প্রতিটি দেশে বড় বড় সভা-সেমিনার করা, কোরআন প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা এবং সকল ধর্মের লোকদের ডেকে ইসলামের শান্তির শিক্ষা সম্পর্কে অবগত করা। আর এ কাজের জন্য যে বিষয়েটি সবচেয়ে প্রথমে প্রয়োজন তাহল সারা বিশ্বের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া। আজকে সারা বিশ্বের মুসলমানদের যদি এক ঐশী নেতা থাকত তাহলে এধরনের গর্হিত কাজের কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না।
আমরা যদি প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইসলামের আদর্শ ভুলে জুলুম নির্যাতনের রাস্তা অবলম্বন করি তাহলে বিধর্মীরা এটা বলতে আরো সাহস পাবে যে, মুসলমানরা সন্ত্রাসী আর এরাই পৃথিবীতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। নাউযুবিল্লাহ। তাই বিধর্মীদেরকে কোনভাবেই অভিযোগের সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না। আমরা যদি প্রতিবাদ করতে গিয়ে দেশের রাস্তা বন্ধ করে রেখে জনগণের কষ্ট দেই তা কিন্তু শ্রেষ্ঠনবির আদর্শের বিপরিত হবে।
কাজি নজরুল ইসলাম তার কবিতায় কত চমৎকারভাবেই না বলেছেন ‘রাসুলের অপমানে যদি কাঁদেনা তোর মন, মুসলিম নয় মুনাফিক তুই রাসুলের দুশমন।’ আসলেই তাই, ইসলামের বিরুদ্ধে যখন কোন বিষয়ে অভিযোগ হানা হয় তখন প্রতিটি মুসলমানের হৃদয় কাঁদে এবং ব্যথা পায় আর এটাই স্বাভাবিক।
আজ যারা শ্রেষ্ঠনবি (সা.) সম্পর্কে কটাক্ষ করে তারা কি এটা জানে না যে, মহানবি (সা.) তো শুধু ইসলামের অনুসারীদের নবি নোন, তিনি তো সারা বিশ্বের সকল জাতি এবং সকল ধর্মের নবি। আর আল্লাহ তাআলা এই মহান নবিকে সমগ্র বিশ্বের জন্য শান্তি ও রহমত হিসেবে পাঠিয়েছেন। শ্রেষ্ঠনবির আগমন বার্তা সকল নবিরাই (আ.) দিয়েগেছেন এবং অন্যান্য নবিগণ এই নবির উম্মত হওয়ার ইচ্ছাও পোষণ করেছেন।
নাউযুবিল্লাহ! আজ সেই মহান রাসুলকে নিয়ে কটাক্ষ করা হচ্ছে। অথচ এই শ্রেষ্ঠনবি (সা.) পশুতুল্য মানুষকে ফেরেশতায় রূপান্তর করেছিলেন। জন্মলগ্ন থেকে যার উছিলায় শান্তির স্বপক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্বময় রহমত আসতে থাকে। কতই না চমৎকার তার আদর্শ, বিশ্বস্ততা, একনিষ্ঠতা, সত্য, ন্যায় এবং ইসলামের শান্তির কথা বলে, কোটি কোটি হৃদয়কে আকর্ষিত করেছিলেন। সমাজে তার (সা.) লড়াই ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠার লড়াই আর এ লড়াই ছিল ভালবাসার মাধ্যমে।
তিনি (সা.) প্রকৃত ইসলামি দর্শন, কুরআন মাফিক বিশাল এলাকা গড়ে তুলতে শাসক হিসেবে, যোদ্ধা হিসেবে, সঠিক সিদ্ধান্ত দেবার ক্ষেত্রে অসাধারণ দৃষ্টান্ত তার উম্মতের জন্য রেখে গেছেন। তিনি (সা.) সমাজে কোন ধরনের অশান্তির লেশমাত্র রেখে যান নি। অন্ধকার সমাজ ছিল, যেখানে কোন আলো দেখা যেত না, সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশটির বুকে আলো জ্বালিয়ে দেখিয়েছেন ইসলাম আসলেই যে শান্তির ও কল্যাণের ধর্ম। তিনি (সা.) শুধুমাত্র একটি সুন্দর সমাজই প্রতিষ্ঠা করেন নাই বরং প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা কি? ইসলাম পালন করলে কি লাভ এবং ইসলাম পৃথিবীতে কেন এসেছে এ সব কিছুই তিনি (সা.) তার কর্ম দ্বারা শিখিয়ে গিয়েছেন।
ইসলাম প্রকৃতই যে জীবনের সকল ক্ষেত্রে শান্তির নিশ্চয়তা দেয় তা-ও তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। ইসলামের গৌরবজনক ইতিহাস, অনুশাসন, ঐতিহ্যবাহী জীবন ব্যবস্থায় নারীর মূল্যায়ণ। পুরুষসহ সকল মানুষের সমান অধিকারের প্রশ্ন ও প্রেক্ষিত এবং সমাধান দেখে ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই ঈমান এনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। সবাই এ কথাও বলতে বাধ্য হয়েছিল, ইসলামই একমাত্র শান্তির ধর্ম হতে পারে। তাই সবাই ইসলামকে শান্তির ধর্ম হিসেবেই গ্রহণ করেছে।
এই শান্তির ধর্মে কোন ধরনের বল প্রয়োগের শিক্ষা নেই। ইসলাম কাউকে হত্যা করার শিক্ষা দেয় না। কাউকে হত্যার ব্যাপারে বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দমার ফয়সালা করা হবে তা হবে রক্তপাত (হত্যা) সম্পর্কিত।’ (বুখারি) কাউকে হত্যা করাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে, শুধু নিষেধ করেই শেষ করে নাই বরং যারা এসব সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কার্যক্রম করে তাদের শাস্তি কত ভয়াবহ সে সম্পর্কেও অবহিত করা হয়েছে। ইসলামের শিক্ষা কত উন্নত যে বল প্রয়োগ করে ইসলামের প্রচার করতে পর্যন্ত বারণ করা হয়েছে।
এত উন্নত শিক্ষা ইসলামের থাকা সত্বেও আজ গুটিকতক উন্মাদরা ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে অভিযোগ করে যে, ইসলাম নাকি সন্ত্রাসের শিক্ষা দেয়। নাউযুবিল্লাহ। অথচ ইসলাম সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সব সময় সোচ্চার। ইসলাম ও মহানবির (সা.) জীবনাদর্শ যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই কতই না উন্নত শিক্ষা ছিল তার। আঘাতে জর্জরিত করা হয়েছে কিন্তু তিনি পাল্টা প্রতিশোধ না নিয়ে করেছেন ক্ষমা। শত্রুদের জন্য দু’হাত তুলে তাদের সংশোধনের জন্য দোয়া করেছেন।
আসুন বিশ্বমানবতার পরম সুহৃদ সেই মহানবির (সা.) সর্বোত্তম আদর্শকে অনুধাবন, অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনে প্রত্যাশিত শান্তি ও সফলতার বাতিঘর প্রজ্বলিত করি। ইসলাম বিশ্বনবির অতুলনীয় জীবনাদর্শকে বিধর্মীদের মাঝে ফুটিয়ে তুলি।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট