মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্রগুলো

প্রকাশিতঃ 10:46 am | October 22, 2020

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:

ছোট্ট একটি খবর, তেমন গুরুত্বও পায়নি গণমাধ্যমে। দুয়েকটি পত্রিকা কিছুটা গুরুত্ব দিয়েছে। জানা গেলো, মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত হয়েছে, এমন আগ্নেয়াস্ত্রগুলো সরকার বিক্রি করে দিতে চায়। যুক্তি হচ্ছে এগুলো পুরনো, অপ্রচলিত এবং যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে অকার্যকর। ফলে রাখার কোনও দরকার নেই। মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র রয়েছে মোট ২৭,৬৬২টি, এর মাঝে ৮ প্রকারের অস্ত্র রয়েছে। সবচাইতে বেশি রয়েছে ০.৩০৩ রাইফেল ৪-এমকে-১ মডেল এর ১৪,৪৫৪টি রাইফেল।
খবরে এটাও জানা গেলো, প্রাচীন নিদর্শন বা স্মৃতিচিহ্ন (অ্যান্টিক সুভ্যেনির) হিসেবে অস্ত্রগুলো কিনে নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ও সুইজারল্যান্ডের একটি অস্ত্র আমদানিকারক কোম্পানি। একটু বিস্মিত হতে হয়, আমাদের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের এসব অস্ত্রের কোনও অ্যান্টিক ভ্যালু নেই আমাদের কাছে, কিন্তু আছে বিদেশিদের কাছে।

আমাদের অনেক বদনাম। আমরা অলস, কর্মবিমুখ, পরনিন্দা-পরচর্চায় মগ্ন, আমরা হুজুগে। কিন্তু এই আমরাই কী প্রবল আবেগে, কী অসামান্য সাহসিকতায়, কী বিশাল আত্মত্যাগে সবকিছু ভুলে, অলস নিদ্রা ছেড়ে, কলহ ছেড়ে স্বাধীন বাংলাদেশ করে ফেলেছিলাম ১৯৭১ সালে। সে এক বিরাট লড়াই ও লাখ লাখ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে জাতির পিতার ডাকে আমাদের নিজস্ব দেশের উত্থান, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

এত বছর পরে এসে একথা শুনতে হয়, মুক্তিযুদ্ধের এই অস্ত্রগুলো রাষ্ট্র বহন করতে পারছে না? এ অস্ত্রগুলো বিক্রি করে দিতে হবে? একজন সামাজিকমাধ্যমে লিখেছেন, ‘এই প্রতিটি অস্ত্রের সঙ্গে মিশে আছে স্বাধীনতার স্বপ্ন, আহত নিহত বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধার হাতের ছোঁয়া।’

আসলে সব ক্ষেত্রেই আমরা নিজেদের ঐতিহ্যকে ভয়ঙ্কর অবহেলা করেছি। আমাদের সর্বস্তরে, সর্বক্ষেত্রে, সর্বধারায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে সর্বব্যাপী উপস্থিতির প্রয়োজন তা আমরা অনুধাবনই করতে পারি না। প্রায়ই আমাদের শুনতে হয়, আমাদের মতো এমন অদ্ভুত উদাসীন এবং ইতিহাস-বিস্মৃত জাতি আর নেই। মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্রগুলো বেচে দেওয়ার ভাবনা সেটারই প্রমাণ হয়তো।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধের আগেকার সব সংগ্রাম ও আন্দোলনে মানুষের ভূমিকা ও সংগ্রামী মানুষদের নিয়ে কোনও মিউজিয়াম নেই, গড়ে উঠেনি সরকারি উদ্যোগে। ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এখন অনেক প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সেটিও হয়েছে কিছু মুক্তিযোদ্ধার ব্যক্তিগত উদ্যোগে। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা, গণ-অভ‌্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনসহ ইতিহাসের ওপর কোনও স্থায়ী প্রদর্শনী নেই কোথাও। আমাদের কোটি মানুষের শরণার্থী জীবন ও সমস্যা নিয়ে লেখা নেই, চিত্র প্রদর্শনী নেই। মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের ভূমিকা, যুব শিবির, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভূমিকা, প্রবাসী বাঙালিদের তৎপরতা, স্বদেশে আটকেপড়া বাঙালিদের ওপর বর্বরতা নিয়ে কোনও কাজ হয়নি। আমরা জানতে পারছি না কী ভয়ংকর অপরাধী ও নৃশংস ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী। তারও একটি স্থায়ী প্রদর্শনী নেই কোথাও। একটা জায়গাতেই এটা করা সম্ভব, দরকার কেবল উদ্যোগ আর উদ্যম।

আগামী বছর পূর্ণ হবে মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর। এখনও একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হয়নি। তথ্য ও গবেষণাসমৃদ্ধ তেমন কোনও কাজ হয়নি বলে একালের প্রজন্ম জানে না সঠিক ইতিহাস, সঠিক তথ্য। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বরং সংঘবদ্ধ চেষ্টা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করতে। আমরা একটা কথা ভুলে যাই যে, ইতিহাস রচিত হয়নি বলে, ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণ হয়নি বলেই বারবার বিকৃতির শিকার হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।

অস্ত্র বেচে দেওয়ার উদ্যোগে বিমর্ষ অনেকেই। মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদারকে উদ্ধৃত করে আরেক মুক্তিযোদ্ধা লিনু হক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘অবক্ষয় আর দৈন্যর কোথায় গিয়ে পৌঁছেছি আমরা। আমাদের মতো কিছু বোকা মানুষের কাছে এর মূল্য অর্থ দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না, এগুলো এক কথায় অমূল্য। বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের জন্য অমূল্য সম্পদ। দিন যত যাবে ততই এর মূল্য বৃদ্ধি পাবে, যদি যথার্থ সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এত দিন অবহেলায় পড়ে থাকার কারণে কিছু মানুষের কাছে আবর্জনা মনে হচ্ছে। আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদও অনুপ্রেরণার জায়গা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। তাই মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত একটি রশির মূল্য অপরিসীম। একটা অস্ত্র, একটা রাইফেল যথার্থ ক্যাপশনসহ জাদুঘরে থাকলে সেগুলো কত আগ্রহভরে শত বছরের পরের প্রজন্ম পড়বে তা কি আমরা ভাবতে পারছি না। হতে পারে একটা অস্ত্রের একটা ক্যাপশন তৈরি করতে পারে সময়ের জন্য প্রয়োজন হাজার মুক্তিযোদ্ধা।’

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল এখন ক্ষমতায়। জাতির পিতার কন্যার হাতে দেশের নেতৃত্ব। আশা করছি মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র বিক্রির ছোট্ট খবরটি বড় হয়ে দেখা দেবে না। আমাদের সামরিক জাদুঘর আছে। সারাদেশে সেনানিবাস আছে। সবখানেই এগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা হতে পারে। কত প্রকল্প হয়, কত খরচ কত জায়গায় হয়। এই অস্ত্রগুলোর জন্যও না হয় কিছু বরাদ্দ হোক।

লেখক: সাংবাদিক

Print Friendly, PDF & Email