শতজনের পথের দিশারী হয়ে বেঁচে থাকুন শতবছর
প্রকাশিতঃ 10:43 pm | September 03, 2020

হুসাইন আজাদ :
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষে তখন। আমার একেবারে কাছের বন্ধুটা তখন একটি দৈনিকের দাপুটে প্রতিবেদক। আর দু’একজনও ক্যাম্পাসভিত্তিক সাংবাদিকতা করছে বেশ ভালোভাবে। পরিচিত সার্কেলের কয়েকজনও স্ব-স্ব জায়গায় প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে নিজেদের। আমি একটি দৈনিকের প্রদায়ক হিসেবে কাজ করছি।
মধ্যবিত্ত ঘরের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রে যা হয়, আমার ক্ষেত্রেও তখন তা কাজ করছিল। অনার্স শেষ হতে আর এক বছর বাকি, তখনো পরিবার থেকে খরচ আনতে হচ্ছিল বিধায় নিজেকে বোঝা ভাবার ভাবনাটা বড় হতে থাকলো। ঘরের লোকজন এক্ষেত্রে আমাকে একেবারে চাপমুক্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও আশপাশের লোকজনের একথা-ওকথায় ঘুম কমতে থাকল। একটা পর্যায়ে এতো চাপ অনুভব করতে থাকলাম যে মানসিকভাবে অস্থিরতা দেখা দিলো। আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুটার বদৌলতে কয়েকটা গণমাধ্যমে যোগাযোগ করলাম চাকরির জন্য। একটা টেলিভিশনের হেড অব প্রোগ্রামের সঙ্গেও যোগাযোগ করলাম, অন্তত ফ্রেশার হিসেবে পরখ করে দেখার জন্য! কিন্তু নিষ্ফল সব প্রচেষ্টা। খুব অসহায় বোধ হতে থাকল।
এই অসহায়ত্ব হালকা করতে নিজের মানসিক চাপ, চাকরির বাজারের মন্দাবস্থাসহ নানা কিছু নিয়ে একটা লেখা লিখলাম। পোস্ট করলাম আলোচিত ব্লগ সামহোয়্যারে। পাশাপাশি মুক্তমতে প্রকাশের জন্য পাঠালাম সেসময়কার তুমুল জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজের এডিটর ইন চিফ ও নিউজরুমের মেইলে।
সেই মেইলে লেখাটা প্রথমে ‘স্বপ্নবালক’ ছদ্মনামে পাঠিয়েছিলাম। মেইলে দেখি বাংলানিউজ থেকে পরিচয় চেয়ে ফিরতি মেইল এসেছে। পরিচয় পাঠালাম! সম্ভবত পরদিন দেখি বাংলানিউজের মুক্তমতে লেখাটা। সেদিন বাংলানিউজের এডিটর ইন চিফ আমাকে মেইল করলেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। সেই মেইল পাওয়ার পর বিস্ময়ে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বারবার রিসিভড মেইলটার সঙ্গে বাংলানিউজের ওয়েবসাইটে গিয়ে এডিটর ইন চিফের মেইলটা মেলাচ্ছিলাম। ঠিকই তো আছে, বাংলানিউজের এডিটর ইন চিফেরই তো মেইল। ২০১২ সালে বাংলানিউজের যে রমরমা অবস্থা, সেসময় সেই প্রতিষ্ঠানের এডিটর ইন চিফের মেইল পাওয়া একটা চাকরিপ্রত্যাশী পড়ুয়ার কাছে কেমন অবিশ্বাস্য, তা তেমন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়া ব্যক্তিমাত্রই বুঝবেন।
এডিটর ইন চিফের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার পর তিনি নিউজরুমের অ্যাক্টিং আউটপুট এডিটরের মাধ্যমে আমাকে ডেকে নিলেন। যেদিন গেলাম, সেদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি। অ্যাক্টিং আউটপুট এডিটর আমাকে একটা ডেস্কে বসিয়ে আন্তর্জাতিক সাইট থেকে যেকোনো একটি কারেন্ট বিষয় নিউজ আকারে দাঁড় করাতে বললেন। ইংরেজি-জুজুতে ভোগা আমি অনেক কষ্টে একটা আইটেম দাঁড় করানোর ঘণ্টাখানেক পর আউটপুট এডিটর সেটাকে সম্পাদনা করে আমার নাম বসিয়ে পাশে তার ইনিশিয়াল (নামের ইংরেজি আদ্যক্ষর) দিয়ে পাবলিশ করে দিলেন।
ক্লাস শেষে সদরঘাট থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় গিয়ে তিন দিন এভাবে কাজ করতে থাকলাম! তৃতীয় দিনের মাথায় আউটপুট এডিটর ডেকে নিয়ে গেলেন এডিটর ইন চিফের রুমে। তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা। দীর্ঘকায় ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের মানুষটাকে প্রথমে দেখে ভড়কে গেলেও তার কোমলকণ্ঠ মুহূর্তটাকে সহজ করে দিলো। তিনি বললেন, তুমি কাজ করতে থাকো, আমরা — তারিখ থেকে তোমার জয়েনিং ধরছি। — সুযোগ-সুবিধা তুমি পাবে। আকাশের চাঁদ হাতে নিয়ে যেন তার রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
সেই যে শুরু হলো, তার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলাম সাড়ে পাঁচ বছরের বেশি সময়। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি জীবন বোঝার জন্য এবং শেখার জন্য কী কী পাঠ দিয়েছেন, তা নিয়ে হয়তো একটা বইও লেখা যাবে, তাতেও হয়তো শেষ হবে না।
যে কিছু কথা না বললেই নয়, তিনি আমার ইংরেজি-জুজুকে ইংরেজিপ্রীতিতে পরিণত করেছেন। রাজনীতি, আন্তর্জাতিক, বিনোদন, খেলাধুলা- সব বিষয়ে আগ্রহী হতে শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন বিশ্বায়নের এ যুগে প্রযুক্তির অগ্রগতি অনুসরণ করতে। বিভিন্ন সময়ই ‘Excellent’ বা ‘Good’ বলে কাজে প্রেরণা যুগিয়েছেন। এমনকি অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য দু’বার ‘বর্ষসেরা কর্মী’র পুরস্কারও দিয়েছেন, পাঠিয়েছেন দেশ-বিদেশ ভ্রমণেও।
পেশাগত এ পাঠের বাইরে তাঁর জীবনমুখী শিক্ষা সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে।
ঊর্ধ্বতনদের অধস্তনদের তরফ থেকে উপহার দেয়ার রেওয়াজ থাকলেও তিনিই মাঝেমধ্যে এটা-সেটা উপহার দিয়ে কর্মীদের চাঙ্গা করে রেখেছেন। একবার আমার নানির জন্য তসবিহসহ ধর্মীয় কিছু সামগ্রী উপহার দিয়েছিলেন। অতিশীপর নানি সেই উপহার পেয়ে কী যে খুশি হয়েছিলেন। রিপোর্টিংয়ে ঢাকার বাইরে বা দেশের বাইরে গেলে তিনি ফোন করে সবার আগে জানতে চেয়েছেন, ‘কিছু খেয়েছো? খাবার-দাবারে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি-না?’ একজন বস হয়ে কাজের খবরের আগে কর্মীর খাবার-দাবারের খবর নেয়া যে তাঁর মানবিক দর্শনেরই প্রকাশ, তা আর বলা লাগে না!
দেশের সার্বিক অবস্থার পাশাপাশি সাংবাদিকতার যে দিনকাল চলছে, তাতে এই পেশায় নিজের ভবিষ্যৎ কতদূর বা ক’দিন তা হয়তো বলতে পারবো না (বহু স্বপ্ন নিয়ে সাংবাদিকতার পুঁথিগত পাঠ নিয়ে এলেও)। তবে যতদিন যেভাবে বাঁচি, কোনো সুপারিশমূলক ফোন ছাড়া, কোনো ইন্টারভিউ বা পরীক্ষা নেয়া ছাড়া একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াকে ডেকে একজন এডিটর ইন চিফের স্বপ্রণোদিত হয়ে চাকরি দেয়ার কথা সারাজীবন মনে থাকবে। হৃদয়ে গেঁথে থাকবে মানসিকভাবে দিগভ্রান্ত একজন তরুণকে একজন এডিটর ইন চিফের পথ দেখিয়ে দেয়ার কথা। শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে পড়বে একজন ডায়নামিক লিডার আলমগীর হোসেনের জন্য।
(কিছুটা দেরিতে) শুভ জন্মদিন ভাইয়া! শতজনের পথের দিশারী হয়ে বেঁচে থাকুন শতবছর!
(২১ আগস্ট আলমগীর হোসেনের জন্মদিন। কিন্তু ২০০৪ সালের ন্যক্কারজনক ঘটনার পর শোকের দিনটিতে জন্মদিন উদযাপন করেন না তিনি)
ছবি: জুলাই ১৪, ২০১৬; ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের ‘মিট দ্য এডিটর’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম এর এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন (তিনি এখন বার্তা২৪.কমের এডিটর ইন চিফ)
লেখক: এসিস্ট্যান্ট নিউজ এডিটর, জাগো নিউজ।