স্বপ্ন আর সাহস বেচবো না

প্রকাশিতঃ 8:57 am | July 26, 2020

তুষার আবদুল্লাহ :

সকালে সবুজ খুঁজতে,শহরের কাছে বানের জল দেখতে গিয়েছিলাম পূর্বাচল। বালু নদীর পাশে বসে চা খাচ্ছিলাম। পরিচিত-অপরিচিত কত গাছ নিজ নিয়মে বেড়ে উঠেছে নদীর পাড়ে। শুনছি উন্নয়ন কাজে কিছু গাছ কাটা পড়তে পারে। মেঘের ছায়া দেওয়ার মতোই মায়া হলো গাছগুলোর জন্য। তেমন এক গাছে এসে ফিঙ্গে এসে বসলো। চায়ের কাপে চুমুক দেই আর ফিঙে দেখি। শ্রাবণের আকাশে চলছে মেঘ রোদ্দুরের খেলা। টঙের দোকানে হিন্দি গান চলছে। ডুমনীর গরুর হাটে রকমারি ঘোষণার পাশাপাশি হিন্দি গানই বাজছে। অস্বস্তি হচ্ছে চারদিকের শব্দে।

নির্জনতার জন্য এসে শোরগোলের মধ্যে পড়ে গেলাম। চায়ের কাপ রেখে উঠে যাচ্ছিলাম। এ সময় দোকানি হাতে আরেক কাপ ধরিয়ে দিয়ে গেলেন। হাঁটতে থাকি নদীর পার ধরে। পেছনে দেখি গানও বদলে গেছে। প্রতুল মুখোপাধ্যায় গাইছেন—হাতের কলম জনম দুঃখী,তাকে বেচো না। মনে হলো উড়ে যাওয়া ফিঙের বুকে এসে তীর বিদ্ধ হলো। দাঁড়িয়ে পড়ি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে ভুলে যাই। প্রতুলের কথাগুলো অস্ফুটভাবে নিজেই উচ্চারণ করতে থাকি—হাতের কলম জনম দুঃখী তারে বেচো না।

নিজের দিকে তাকাই। চারপাশের পরিচিত মানুষগুলোর মুখচিত্র এসে চোখের সামনে ভাসতে থাকে। একেকটি মুখ উল্টে পাল্টে দেখতে থাকি। সবাই তো দেউলিয়া হয়ে বসে আছি কলম বেচে দিয়ে। কলমতো সত্যিই জনম দুঃখি। সত্যি কথা বলার জন্য তার কী আকুতি। কত লড়াই। মুখ ফুটে সত্য বের হতে হতেও যেন ঠোঁটে আটকে থাকে। সত্য বের হয়েছে কি কোনও কালে? বড় জোর হয়তো ঠোঁটের দ্বার পর্যন্ত এসে থেমে গেছে। এই থেমে যাওয়ারও ধ্বনি আছে, আওয়াজ আছে। তাই প্রতিধ্বনিত হয়। সমাজ,রাষ্ট্রে বিজ্ঞাপিত হয় কলম সত্য বলে। সত্য প্রকাশ করছে। এই বিজ্ঞাপন, কত ভুল জানে কলম। কারণ তাকে এক খাম টাকা, জমকালো পরিচ্ছদ, লোভনীয় ভ্রমণ এবং আরও কিছুতে লোভাতুর হয়ে কবেই তো বেচে দেওয়া হয়েছে। একদম বাদাম বেচার চেয়েও তুচ্ছ করে।

কাদের কাছে বেচে দিয়েছি কলম? ঠিকাদার,আমলা, টাউট কে বাদ গেছে। কলম বেচতে রুচিতে ঠেকেনি কিছুই। সামান্য লুঙ্গি,গামছা কিংবা এক গ্লাস তরলের জন্য বেচে দিলে কলমের তো দুঃখ হতেই পারে। কলম চরম ধৈর্যশীল সইতে সইতে কখনও কোনও কলমের বাঁধ ভেঙেছে। কিন্তু সেই বাঁধে দেয়াল তুলে দিয়েছি আবার আমরাই। ঝর্ণা কলম, বল পয়েন্ট সবার মাঝে যখন ক্লান্তি এসে ভর করেছে, তখনই এসে যোগ দিলো কিবোর্ড, সামান্য পরে মাইক্রোফোন।

এরা যেন সস্তা বাজারের জন্যই তৈরি। হাওয়াই মিঠাইয়েরও এক রকম ব্যক্তিত্ব আছে। নিজের জাতপাতের কথা ভাবে বাজারের বৈচা মাছও। কিন্তু মাইক্রোফোন আর কিবোর্ড যেন হয়ে উঠেছে ধামাকা অফার আর নিলামের পণ্য। ক্রেতা আমাদের খোঁজ করে না। আমরাই ক্রেতার কাছে গিয়ে বলছি, আমি তোমার কাছে বিক্রি হয়েই আছি। আমাকে ব্যবহার করো। যেমন করে চাও তেমন করেই। আমি তোমার, তোমাদের কেবলই।

যখনই সমাজের কোনও অন্ধকার প্রকাশিত হয়। সমাজ, রাষ্ট্রের কোনও একটি গোষ্ঠীর আস্ফালন দেখা যায়। তখন চোখ বুজে দেখা যাবে সেখানে কলম,কিবোর্ড, মাইক্রোফোনের মানুষের পাশে আছে। তারা কারও না কারও সাফাই গেয়ে যাচ্ছে।

এমনিতেই পুঁজিবাদী সমাজে এই মানুষগুলো ‘জার্মান শেফার্ডের’ কাজ করে পুঁজির পক্ষে। এর বাইরেও সমাজের অপরাধ শ্রেণির পক্ষেও বন্দনা সংগীত গাইতে শোনা যায়। একক কণ্ঠে যেমন,আবার সমবেত কণ্ঠও সরব। আমরা সাম্প্রতিক ও নিকট অতীতে অপরাধ ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার ও টাউট শ্রেণি নিয়ে যখন হাঁকডাক শুরু হলো তখন দেখতে পেলাম,তাদের পাশে কলম,মাইক্রোফোন, কি-বোর্ড বেচা মানুষগুলোকেও।

হয়তো আমরা সকলেই নিজের অজান্তেই বিক্রি হয়ে বসে আছি। তবে এই বিশ্বাসটুকু এখনও রাখতে চাই। তাদের সংখ্যাই বেশি যারা জনম দুঃখী কলম, মায়াবী কি-বোর্ড, সাহসী মাইক্রোফোন আঁকড়ে ধরে আছে। লাখ লোভনীয় অফারেও তারা বিশ্বাস, ভালোবাসা এবং স্বপ্নকে বিক্রি করবে না। এই বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে, বারবার লড়াইয়ে জিতে যাবে সেই সমাজের চোখে অসচ্ছল, অসীম সুখী সেই মানুষগুলোর জন্যই।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি

Print Friendly, PDF & Email