টকশোতে ক্লান্ত দর্শক!

প্রকাশিতঃ 8:38 am | July 12, 2020

তুষার আবদুল্লাহ :

যারা টকশো’র জন্মলগ্ন কালের দর্শক, তারা বলতে পারবেন কেমন করে ধীরে ধীরে টেলিভিশনের পর্দা থেকে নিখোঁজ হলেন। বিলুপ্ত হয়ে গেছেন আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মানুষেরা। টকশো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ২০০৮-এর নির্বাচনের আগে থেকে। ১/১১ এর সময়ও রাখঢাকের মধ্যেও যে টকশো চলছিল, সেগুলোও রাত জেগে দেখে ঠকেননি দর্শকরা। ২০০৮, ২০১৩ এবং ২০১৮-এর নির্বাচন পূর্ব সময়ের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, টানাপড়েন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার মেরুকরণের পাশাপাশি টকশোর বিষয় হয়ে উঠেছিল জঙ্গিবাদ এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার। গণজাগরণ মঞ্চ, কিশোর বিদ্রোহ, নো-ভ্যাট আন্দোলনের পাশাপাশি অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিষয়েও টেলিভিশনগুলোর আলোচনার প্রতিপাদ্য হয়ে উঠেছিল।

বিশেষ করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপি বয়কট করার পর থেকে বিরোধী দলের জন্য বিকল্প সংসদ হয়ে উঠেছিল টেলিভিশন টকশো।

সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত টকশো দেখা টেলিভিশন ভোক্তাদের প্রাত্যহিকতার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোন চ্যানেল কোন বিষয় নিয়ে টকশো করছে, আলোচকরা কারা কোন চ্যানেলে কী কথা বলছে এ নিয়েও দর্শকদের অসীম আগ্রহ ছিল। দর্শকরা চলতি রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনার বিষয়ে নিজের চিন্তাকে মিলিয়ে নিতেন টকশোর আলোচকদের সঙ্গে। ভোক্তাদের টকশো আসক্তিতে কোনও কোনও টেলিভিশন চ্যানেল সারাদিনে একাধিক টকশো প্রচার করতে শুরু করে। এটা একদিকে টেলিভিশনের জন্যও ছিল সাশ্রয়ী। কারণ যেখানে হাজার ছয়েক টাকায় ঘণ্টা পার করে দেওয়া যায়, সেখানে বাড়তি খরচ করে অন্য অনুষ্ঠান তৈরি খামাখা অপচয়ই বটে!

দর্শকদের টকশো আসক্তিতে আলোচকরা তারকা বনে যান। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মতোই তারা সেলিব্রেটি ঢঙে চলতে থাকেন পর্দার বাইরে। তিনি রাজনীতির পাতি নেতা হন আর শিক্ষক বা আইনজীবী হন; ধীরে ধীরে নিজেকে তারকার আদল দিতে থাকেন। টকশোকে খণ্ডকালীন পেশা হিসেবেও নিয়ে নেন একটি বড় অংশ। তারা অর্থনীতি, রাজনীতি, গ্যাস সংকট, বিদ্যুৎ সংকট, শিক্ষা, আইন, আন্তর্জাতিক সমস্যা, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ক্রিকেট, নায়িকার ডিভোর্স, জগতের এমন কোনও বিষয় নেই যে বিষয় নিয়ে তারা বলার যোগ্যতা রাখেন না। তাদের জ্ঞানের বহুমাত্রিকতায় দর্শকদের চোখ ছানাবড়া।

মুশকিল হলো যারা প্রকৃত অর্থেই কোনও একটি বিষয়ে জ্ঞাত, তাদের উপস্থিতি টকশোতে নগণ্য। অনেক প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং শিক্ষককে কখনও টকশো মঞ্চে বসানো যায়নি। তারা আসেননি। অথচ তাদের বক্তব্য বা দিকনির্দেশনা আম মানুষের জানার প্রয়োজন ছিল। অতি অল্প যাদের পাওয়া গেছে ধীরে ধীরে তাদের অনুপস্থিতি বাড়ছে। কারণ গণমাধ্যম এবং টেলিভিশন এখন এমন অনেক মানুষকে এনে পর্দার সামনে ঝুলিয়ে দিচ্ছে, যারা বাজছে বেশি খালি কলসির মতো। ঝগড়াতো আছেই, ভুল তথ্য বিলি করছেন এ প্রকারের মানুষেরা।

এ ধরনের মানুষগুলো রাজনীতিসহ বিভিন্ন পেশায় আচমকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। বলা হয় অনেকে সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া থেকে প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রী হয়েছেন টকশোর বাচালতার কারণে। তারা শীর্ষ নেতা-নেত্রীদের তোষন করে নজরে আসার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিল টকশোকে। অনেক প্রকৌশলী, আইনজীবী, চিকিৎসকের পসার বেড়েছে টকশোতে হাজির হয়ে। এর আগে হয়তো তিনি নিজ পেশার তলানির দিকে ছিলেন, কিন্তু টকশোতে মুখ দেখিয়ে পেশাগত দক্ষতা না বাড়লেও পসার বাড়ছেই। পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনেও একটু খায়েশ তৈরি হয়েছে কারও কারও। সেই খায়েশ মেটানোর তৌফিকও অর্জিত হয়েছে কারও কারও।

টকশোতে এমন অনেক অতিথি আছেন, যাদের পেছনে ছুটতে ছুটতে ঘর্মাক্ত টেলিভিশন। আবার অনেক অতিথি আছেন যারা জুতোর সুখতলা বা টেলিফোনের ব্যালেন্স শেষ করে ফেলছেন তদবির করতে করতে। টেলিভিশনের প্রযোজক, মালিকপক্ষই শুধু না, সরকারের বিভিন্ন দফতরের মাধ্যমেও তদবির করে যান অনেকে। কারও কারও তদবিরে পোষায় না। সরাসরি উৎকোচ নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। টাকা, শাড়ি, স্যুট, ফ্ল্যাট তৈরির কিস্তি, সোফাসেট, সন্তানের টিউশন ফি, বিমানের টিকিট, তরল বোতল থেকে শুরু করে আরও বেশি কিছুর বিনিময়ে আদায় হয় অতিথি হওয়ার সুযোগ। সঞ্চালক, প্রযোজক থেকে শুরু করে সম্পাদনা পরিষদও সেই উৎকোচের অংশীদার হন, এমন কথা বাজারে ভাসে।

শুধু উৎকোচেই পর্দায় টিকে থাকা যায় না। তাই এই প্রকারের টকশোওয়ালারা সামাজিক গোত্র তৈরি করে ফেলে। টকশোর সঞ্চালক, প্রযোজক ও সম্পাদনা পরিষদের লোকজন এবং সমাজের কিছু গণমান্য ব্যক্তি নিয়ে তৈরি গোত্রটি বাড়ি বাড়ি তরল ও ভালোমন্দ খাবারের পার্টি থেকে শুরু করে কফিশপ এবং অভিজাত হোটেলের আড্ডায় একত্রিত হন নিয়মিতই। সেখানেই কে কবে কোথায় টকশোতে যাচ্ছেন বা সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে প্রবেশের সুযোগ কেমন করে পাওয়া যায় সেই দরদাম থেকে শুরু করে ব্যবসার লেনদেনও চলে।

এসব গোত্রের তৎপরতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সাধারণের চোখে পড়ে। তারা ধারণা করে নেন, কে কেন কীভাবে টকশোতে নিয়মিত সুযোগ পাচ্ছেন, কথা বলার কোনও যোগ্যতা না থাকার পরেও। এ প্রকারের মুখগুলোকেই দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন অপরাধ ও কেলেঙ্কারির হোতা হিসেবে। সেই হোতাদের সঙ্গে গণমাধ্যম ও সরকারের বিভিন্ন দফতরের দায়িত্বশীল মানুষদের ছবি ও ঘনিষ্ঠতার কথাও দর্শকদের কাছে প্রকাশ পেয়ে যায়। এ প্রজাতির টকশোর অতিথিদের উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় সুবক্তা ও সু-আলোচকরা লজ্জিত হয়ে সরে যাচ্ছেন টকশো থেকে। একইভাবে দর্শকরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন মানহীন টকশো দেখে। টকশো নিয়ে তাদের মাতামাতির সময় এখন বিগত। টকশো মূলত এখন টেলিভিশন সময়ের অপচয়।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি

Print Friendly, PDF & Email