কৃষিই পারে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে
প্রকাশিতঃ 9:16 am | July 09, 2020

ড. মো. তাসদিকুর রহমান সনেট:
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার একটি ছোট দেশ বাংলাদেশ। ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটারের এই দেশটি সমগ্র বিশ্বে উন্নয়ন ও অগ্রগতির রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের উন্নয়নে যুগের পর যুগ ধরে অবদান রেখে চলেছে কতিপয় সেক্টর। এই সেক্টরগুলো হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প, রেমিটেন্স ও কৃষি। দেশীও আয়ের সিংহভাগ আসে এই তিনটি খাত থেকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপিতে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান প্রায় ১৬%, রেমিটেন্স খাতের অবদান প্রায় ৪.৯৩% এবং কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১৩.৬৫%।
দেশটির উন্নয়নে এই তিনটি সেক্টরের দৃশ্যত অবদান ক্রমান্নয়ে বেড়ে যাবে এমনটাই ধারণা ছিল সকলের মনে। কিন্তু ২০১৯ সালের শেষভাগে চীনে যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ হয় তা পরবর্তীতে ছড়িয়ে পরে সমগ্র বিশ্বে। আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিও এর বাইরে নয়। ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগী ধরা পরে। এরপর ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে আক্রান্তের সংখ্যা। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন অনেকে।
জুলাই ৮, ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১,৭২,১৩৪ জন ও মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১৯৭ জনে। বাংলাদেশের কোভিড-১৯ সংক্রমণ মোকাবিলায় এগিয়ে এসেছে সকল ন্তরের পেশাজীবীরা। যাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করছে ডাক্তার, নার্স, পুলিশ বাহিনী, প্রশাসন ক্যাডার ও সকল স্তরের কৃষিবিদ। এ সকল পেশাজীবীরা যেমন নিরলসভাবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ জনগণের সেবায় তেমনি নিজেরাও আক্রান্ত হয়েছেন বা হচ্ছেন এই সংক্রামক ব্যাধিতে।
কোভিড-১৯ সংক্রমণজনিত কারণে দেশের উন্নয়নের চাকা সচল রাখতে এবং জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সীমিত পরিসরে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে বিশ্ব বাজারে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের চাহিদা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা দেশে চলে আসছেন অথবা রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্পের চাহিদা কমে যাওয়ায় বেকার হচ্ছে দেশের শ্রমজীবীদের একটি বৃহৎ অংশ।
অন্যদিকে প্রবাসীরা দেশে ফেরত আসায় বেকারত্বের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য দুইটি খাতের চেয়ে কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা সহজ হবে। এই বেকার জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই থাকেন গ্রামাঞ্চলে। কৃষিতে বিশাল এই জনসংখ্যাকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে খাদ্য-নিরাপত্তার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্র তৈরিতে অবদান রাখতে পারবে।
বর্তমান সরকার কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ও এর পরবর্তী সংকট মোকাবিলায় হাতে নিয়েছে নানাবিধ উদ্যোগ। বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশে। আজও দেশের অধিকাংশ জনগণ এই আদি ও অকৃত্রিম পেশায় জড়িত। তাই বর্তমান সরকার কোভিড-১৯ আপৎকালীন ও এর পরবর্তী সময়ের সংকট মোকাবিলায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশের কৃষির ওপর। তারই প্রেক্ষিতে ২০২০-২১ এর বাজেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কৃষি সেক্টরের জন্য।
বাংলাদেশের বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার খুবই দ্রুত অনুধাবন করেছে যে এই আপৎকালীন কৃষিই পারে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে। যেখানে করোনা আপৎকালের শুরুতে ধারণা করা হচ্ছিল যে দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সে সময়ে প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় রেখেছে এক অনবদ্য নিদর্শন। চলতি মৌসুমে কৃষক পর্যায়ে অর্ধেক মূল্যে কম্বাইন্ড হারভেস্টার বিতরণ করা হয় যার দ্বারা অতি দ্রুত ধান উত্তোলন নিশ্চিত হয় এবং বাংলাদেশে রেকর্ড পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়।
২০১৯-২০ মৌসুমে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় কৃষির ওপর জোর দিয়ে বলেছেন যে দেশের আবাদযোগ্য এক ইঞ্চি জমিও যেন বাদ না থাকে। কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরবর্তী সময়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে দেশের জনগণের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বর্তমান সরকারের গৃহীত সকল পদক্ষেপ সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে। আর এই সকল পদক্ষেপ বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে দেশের সকল কৃষিবিদ ও কৃষকগণ। দেশের বর্তমান বেকার সমস্যা সমাধানে কৃষিখাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। পৃথিবীর অনেক দেশই অতীতের পেশা কৃষিতে আবার ফিরে গিয়েছে।
বর্তমানে দেশের কৃষির সাফল্যের নেপথ্যে যারা নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন তারা হচ্ছেন কৃষক ও সকল স্তরের কৃষিবিদগণ। বর্তমানে আপৎকালীন দেশের খাদ্য জোগানে কৃষিবিদগণ কৃষিকাজের বিভিন্ন প্রযুক্তি কৃষকদের মাঝে পৌঁছানোর জন্য মাঠ পর্যায়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। কৃষিবিদগণ কৃষকদের সেবা প্রদানের জন্য কোভিড-১৯ সংক্রমনের ঝুঁকি নিয়েই নিজেদের সর্বদা নিয়োজিত রেখেছেন। ইতোমধ্যে ১৬৪ জন কৃষিবিদ কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হয়েছেন এবং এর মধ্যে মারা গিয়েছেন ১৪ জন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. আব্দুল মুঈদসহ ৭৭ জন কৃষিবিদ সুস্থ হয়েছেন। আরো ৭৪ জন কৃষিবিদ বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন। দেশের অন্য পেশাজীবীদের ন্যায় কৃষিবিদগণ সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবিলায় নিজেদের সর্বদা নিয়োজিত রেখেছেন।
কৃষিবিদ ও কৃষকরাই পারেন দেশের এই সংকটকালীন দেশের জনগণের খাদ্যঘাটতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ অবদান রাখতে। দেশের জনগণের খাদ্য ঘাটতি ও সুষম খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য ও শাক-সবজি উৎপাদনের জন্য সকল স্তরের কৃষিবিদ ও কৃষক নিরলসভাবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন ও পরবর্তীতেও নিজেদের নিয়োজিত রাখবেন। তাই অন্যান্য পেশাজীবীর ন্যায় কৃষিবিদদের সরকারি প্রণোদনার আওতায় আনা প্রয়োজন। কৃষিবান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রীর নিকট আকুল আবেদন ও প্রত্যাশা তিনি সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করতে গিয়ে যেসব কৃষক ও কৃষিবিদ আক্রান্ত হয়েছেন বা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের সম্মুখযোদ্ধা ঘোষণা করে প্রয়োজনীয় সহায়তা ও প্রণোদনা প্রদান করবেন।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট, ঢাকা মেট্রোপলিটন।