করোনা মোকাবিলায় শিক্ষক ও ইমামের ভূমিকা

প্রকাশিতঃ 10:41 am | March 26, 2020

অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু :

করোনা মোকাবিলায় শিক্ষক ও ইমামের ভূমিকা
সারাবিশ্ব এখন করোনাভাইরাসে আতঙ্কিত। চীনের উহান প্রদেশে ভাইরাসটি প্রথম আঘাত হানলেও তা আজ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের অন্তত ১৯০টি দেশে করোনা বিস্তৃতি লাভ করেছে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার মানুষ মারা গেছেন। আক্রান্তের সংখ্যা চার লাখের ওপরে। বাংলাদেশেও করোনাভাইরাস হানা দিয়েছে। ইতোমধ্যে চারজন মারা গেছেন। এরই মধ্যে সারাদেশে ব্যাপক আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সরকার করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো উন্নত বিশ্ব যেখানে ভাইরাসটি মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে সেখানে আমাদের মতো দেশের পক্ষে শুধু সরকারের পক্ষে এই দুর্যোগ মোকাবিলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার ব্যাপক গণসচেতনতা। জনগণকে সচেতন করতে না পারলে ব্যাপক জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশে সরকারের একার পক্ষে এই মহাদুর্যোগ সামাল দেয়া খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

গণসচেনতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সমাজে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন তাদের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্মানিত শিক্ষক, মসজিদের সম্মানিত ইমাম/খতিব, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সুশীল সমাজ, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সমাজের এই অংশটি সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব রাখেন। এক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ কথা অনস্বীকার্য এক্ষেত্রে শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম ও খতিবদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে সব মিলিয়ে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটিসহ শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে প্রায় পাঁচ কোটির অধিক মানুষ। শিক্ষকরা সম্মানীয় অংশ হিসেবে সমাজে সমাদৃত। তারা সমাজ বিনির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক এই দুর্যোগে এদেশের শিক্ষক সমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। একজন শিক্ষক যখন জনগণকে করোনাভাইরাস সম্পর্কে সতর্কতার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন তা অধিক ফলদায়ক হবে। সাধারণ মানুষ শিক্ষকদের কথা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

শিক্ষক ছাড়াও মসজিদের ইমাম/খতিব কিংবা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরাও জাতির এই চরম দুর্যোগময় মূহুর্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। বাংলাদেশে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় তিন লাখ মসজিদ রয়েছে। এসব মসজিদের ইমাম/খতিব সরাসরি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাথে সম্পৃক্ত। সমাজে সকলেই তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখে থাকেন। এ সকল সম্মানিত ইমাম/খতিবরা সমাজে যথেষ্ট প্রভাব রাখেন। তারা যখন কোনো বিষয়ে মতামত প্রদান করেন, সমাজ তা সহজেই গ্রহণ করে। করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগময় সময়ে জনগণকে আতঙ্কিত না হয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে ধৈর্যের সাথে তা মোকাবিলা করার জন্য সমাজে ইমাম/খতিবরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগময় মুহূর্তে জনগণ আতঙ্কিত হয়ে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক পরিমাণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী সংগ্রহ করতে গিয়ে বাজার অস্থির করে তুলেছে। এক শ্রেণির সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী এ সময় রাতারাতি চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দামবৃদ্ধি করে অধিক মুনাফা লাভের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। যে সময় দেশের সকল শ্রেণির পেশার মানুষের সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেয়া উচিত, সেই মুহূর্তে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অনৈতিক প্রতিযোগিতা রোধে শুধু সরকারের একার পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন সর্বসাধারণের দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সহযোগিতার বাড়িয়ে দেয়া। এ ক্ষেত্রেও দেশের শিক্ষক সমাজ ও মসজিদের ইমাম/খতিব, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, মিডিয়া এবং সুশীল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

দেশের এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তারদের কাজে লাগানো যেতে পারে। দেশে অনেক অভিজ্ঞ ও সক্ষম ডাক্তার আছেন। তাদের সরকারি উদ্যোগে এবং ব্যবস্থাপনায় করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। বিশেষ করে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এসব প্রবীণ ডাক্তারদের লব্দ অভিজ্ঞতা এই দুর্যোগে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।

বাংলাদেশ করোনাভাইরাস এখনও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে না পড়লেও, ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় সরকার তার সাধ্যমতো বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে। তথাপিও এক শ্রেণির মানুষের অপপ্রচার, মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। এক্ষেত্রে তারা বেছে নিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেহেতু এখন অনেক শক্তিশালী সেহেতু এসব অপপ্রচারে জনগণ বিভ্রান্ত হচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।

এই মুহূর্তে উচিত সকল রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে গিয়ে সম্মিলিতভাবে দলমত নির্বিশেষে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় দেশের এই দুর্যোগ মোকাবিলা করা। তবে আশার কথা হলো দেশি-বিদেশি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে চীনের বিপুল চিকিৎসা সামগ্রীসহ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার প্রেরণ, একটি বিদেশি পোশাক তৈরি কোম্পানি বিপুল সংখ্যক পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) বাংলাদেশে তৈরির উদ্যোগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মোকাবিলায় চাই জাতীয় ঐক্য। আমাদের সকলের মনে রাখতে হবে দেশটা আমাদের সকলের। যে জাতি যুদ্ধ করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে, সে জাতি কোনো দুর্যোগের কাছে পরাজিত হতে পারে না। এ জন্য প্রয়োজন সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। করোনাকে ভয় নয়, সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাকে জয় করতে হবে।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ
ও সচিব, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট, শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

Print Friendly, PDF & Email