মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি : আমরা কি মানুষ হতে পেরেছি?
প্রকাশিতঃ 3:24 pm | July 25, 2025

ইয়াহিয়া নয়ন:
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সেদিন বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা আমরা সবাই জেনেছি। ঘটনার পর থেকে ধীরে ধীরে এর ভয়াবহতা প্রকাশ্যে আসছে। কী দেখলাম, কী দেখছি- প্রতিটি মুহূর্ত যেন কাটছে ঝলসে যাওয়া বক্ষে পিতার এক ভয়াবহ যন্ত্রণার মধ্যে। কল্পনায় দেখছি- আগুনের ভেতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসছে আমার সন্তান, যার পুরো শরীর ঝলসে গেছে, তবুও সে বাঁচার জন্য ভিড় ঠেলে দিগ্বিদিক ছুটছে।
যখন দেখি সন্তানের খোঁজে দিগ্বিদিক ছুটছেন মা, তখন আমরা নিজেদের সন্তানদের দিকে তাকাতে পারছি না। এই স্কুলে তো আমার সন্তানও পড়তে পারতো। অথবা আমার সন্তানের স্কুলেও ঘটতে পারত এমন ঘটনা। কী অনিশ্চিত মানব জীবন, কতই না অদ্ভুত! মৃত্যু সে তো চিরন্তন সত্য; তবে এমন মৃত্যু শুধু কাঁদায় না, হতবাক করে দেয়।
আমরা জানি, এই মৃত্যু কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শিশুদের খেলার মাঠে রক্ত ঝরবে, স্কুলের দেওয়ালে আঁকা থাকবে না আর রঙিন ফুল-পাখি এই ভবিষ্যৎ কোনো মানবসভ্যতার স্বপ্ন হতে পারে না। যারা আজ নিহত হয়েছেন, তারা ফিরে আসবে না। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব রয়ে গেছে এই মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে যেন ঘৃণা, গুজব, প্রতিশোধ বা হিংসার রাজনীতি ছড়িয়ে না পড়ে।
দুঃখজনকভাবে সাম্প্রতিক এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় আমরা সেই পর্যায়ের পেশাদারত্ব ও প্রস্তুতির মারাত্মক ঘাটতি প্রত্যক্ষ করলাম। কোথাও কেউ তথ্য সমন্বয় করছে না, কোথাও তালিকা নেই, কোথাও একাধিক লোকজন একই কাজ করছে ফলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। আমরা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লাম, যা মানবিকভাবে স্বাভাবিক হলেও, রেসকিউ অপারেশনে এই আবেগ অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
যে কাজগুলো আমাদের জরুরি ভিত্তিতে করার কথা ছিল, তথ্য সংগ্রহ, তালিকা প্রস্তুত, সেন্ট্রাল মনিটরিং চালু, তা কেউই দায়িত্ব নিয়ে করলেন না। উদ্ধার তৎপরতায় তথ্য যদি গুছানো না থাকে, তাহলে সেটি পরিণত হয় এক বিশৃঙ্খল চিত্রে, যা দুর্ঘটনার শোককে আরও দীর্ঘতর করে। এখন সময় পেশাদার মানসিকতা গড়ে তোলার, যাতে ভবিষ্যতের রেসকিউ আরও কার্যকর হয়, শুধু আবেগে নয়, তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনায়।
ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটি এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এমন একটি অঞ্চলে অবস্থিত, যা নগরীর অন্যতম জনবসতিপূর্ণ এলাকাকে ঘিরে রেখেছে। উত্তরা, বনানী, মিরপুর সবই এই আকাশপথের আওতায়। কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি বা জরুরি পরিস্থিতিতে পাইলটের সামনে বিকল্প অবতরণের সুযোগ নেই। অথচ সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচলে আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশনের নির্দেশনা মানে।
নিয়ম অনুযায়ী, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার ওপর ১,০০০ ফুট উচ্চতায় উড্ডয়ন বাধ্যতামূলক। কিন্তু সামরিক ফ্লাইটের ক্ষেত্রে এমন সুস্পষ্ট ও বাধ্যতামূলক নিয়ম নেই। এফ-৭ বিজিআই বিমানটিও মূলত খোলা আকাশের জন্য উপযুক্ত। উচ্চতর দক্ষতা আর স্বয়ংক্রিয়তার সীমাবদ্ধতায় শহরের আকাশে নিয়ন্ত্রণ হারালে পাইলটের কিছুই করার থাকে না। মাইলস্টোনের ঘটনায়ও তাই হয়েছে।
একটি কথা না বললেই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ক্লিপ বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। তা দেখে শত চেষ্টা করেও নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলাম না। অজান্তেই হৃদয় প্রশ্ন তুললো আমরা আসলে কবে মানুষ হবো? সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একটি শিশু নিদারুণ কষ্টে হেঁটে হেঁটে কোথাও নিরাপদ স্থানের খোঁজে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। শরীর তার সাড়া দিচ্ছে না; চোখের পানি আগুনের তাপে শুকিয়ে গেছে।
তার শরীরের পোশাক আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে, বাচ্চাটি অর্ধ-উলঙ্গ অবস্থায়। সে হয়তো এতটাই করুণ অবস্থায় যে কারও থেকে সাহায্য চাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ তার মুখের কথা ভয়াবহ সেই আগুন কেড়ে নিয়েছে যেন। অথচ কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যাচ্ছে না, সবাই সেই শিশুটির ভিডিও করায় ব্যস্ত। এসব ভিডিও দেখে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি সত্যিই মানুষ হতে পেরেছি?
ঠিক তার বিপরীতে কেউ আবার রক্ত দিতে ছুটে যাচ্ছেন হাসপাতালে। চিকিৎসক দিনরাত নির্ঘুম সেবা দিয়ে যান। অনেক সময় আমরা শুধু দুর্ঘটনায় নিহতদের কথা ভেবেই অশ্রুসিক্ত হই। কিন্তু দেশপ্রেমিক ও মানবিক মানুষগুলো যারা উদ্ধার কাজে অংশ নেন তাদের কষ্টগুলো পেছনেই থেকে যায়।
এ দুর্ঘটনায় আমরা অনেক কিছু দেখেছি এবং দেখছি। দেশের ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি, পুলিশ, রেড ক্রিসেন্টসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ এমন বিপদে এগিয়ে আসেন। কাজ করেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। অথচ এরই মধ্যে কিছু দুষ্ট চক্র অপপ্রচার করে, বিভ্রান্তিকর ছবি ও ভিডিও দিয়ে মানবিকতার দুয়ার থেকে সরে দাঁড়ায়। সব কিছুর মধ্যেই তারা ‘কিন্তু’ খুঁজে পায়! শোক ও সান্ত্বনার আশ্রয়ে কেউ কেউ রাজনৈতিক ফায়দা লোটে। ভিউ আর অর্থের লোভে বীভৎস প্রচারে মেতে ওঠে অনেকে।
যা হোক; এমন ট্র্যাজেডি অনেক কিছুরই শিক্ষা দেয়। যারা সেই শিক্ষা থেকে ভালোকে গ্রহণ করতে পারেন তারা মানবিক হয়ে ওঠেন। আর মানুষ হিসেবে মানবিক হওয়াটাই জরুরি। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিমান দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, কতখানি অগ্রগতি এখনো প্রয়োজন। আমাদের সামরিক বাহিনীকে আধুনিক করা যেমন প্রয়োজন, তেমনি নিজেদের মনোভাবও পরিবর্তন করতে হবে। প্রযুক্তি, শৃঙ্খলা ও মানবিকতা— এই তিনটির সমন্বয় ছাড়া নিরাপদ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়।
লেখক : সাংবাদিক।