জলাবদ্ধতার ভোগান্তি থেকে নিষ্কৃতি নেই নগরবাসীর

প্রকাশিতঃ 4:19 pm | May 28, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয় রাজধানীতে। সড়কপথ দেখলে মনে হয় এ যেন নৌপথ। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার তিন থেকে চার ঘণ্টা পরেও জলাবদ্ধতা থাকে অনেক এলাকায়। এটি রাজধানী ঢাকার নিয়মিত চিত্র। বারবার আশ্বাসের কথা শোনা গেলেও এই ভোগান্তি থেকে নিষ্কৃতি মিলে না নগরবাসীর। তারা এখন এটাকে অনেকটা নিয়তি হিসেবেই মেনে নিচ্ছেন। অথচ জলাবদ্ধতা নিরসনে বহু প্রকল্প ও পদক্ষেপ নিয়ে আসে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু  ফলাফল যেন শূন্যই থেকে যাচ্ছে। কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। ফলে এবারও ডুববে ঢাকা—  এমন আশঙ্কায় আতঙ্কিত নগরবাসী।

জানা যায়, প্রতি বছরই জলাবদ্ধতা নিরসনে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয় সরকার। বছর বছর অর্থ বরাদ্দের পরিমাণও বাড়ে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। ক্ষেত্রবিশেষ ভোগান্তির পরিমাণ বাড়ে। বছরের পর বছর জলাবদ্ধতা নিরসনে বহু প্রকল্প ও পদক্ষেপ হাতে নিয়ে প্রচুর অর্থ খরচ করেছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটি কর্পোরেশন প্রায় ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল, কাজও করেছে কিছু। কিন্তু ফল ছিল শূন্য।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানায়, জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ২০২৩- ২৪ অর্থবছরে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দের ২০০ কোটি টাকার মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) জলাবদ্ধতা নিরসনে সরাসরি ৯০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখে। এছাড়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের (খাল, জলাশয়, নর্দমা পরিষ্কার) জন্য ৩০ কোটি টাকা, খাল-পুকুর ও জলাশয় পুনরুদ্ধারে আরও দুই কোটি টাকা এবং পানির পাম্প ক্রয় ও স্থাপনে আরও এক কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়।

একই সঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে পাম্প হাউজের যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও ক্রয়ে বরাদ্দ রাখে ২৫ কোটি টাকা। খালের উন্নয়ন, সীমানা নির্ধারণ ও বৃক্ষরোপণে বরাদ্দ রাখে আরও ৩৮ কোটি টাকা। এছাড়া, নর্দমা পরিষ্কারে ১১ কোটি, খাল পরিষ্কারে পাঁচ কোটি, খাল-কালভার্ট মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে ১০ কোটি, পাম্প হাউজ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে আট কোটি, লেক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে তারা।

দুর্যোগ, সাধারণ বৃষ্টি কিংবা বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টি- যেটাই হোক না কেন জলাবদ্ধতা ঢাকার মানুষের এসময় সঙ্গী হয়। মূল কথা টানা বৃষ্টি মানেই ঢাকার সড়কে জলাবদ্ধতা। বর্ষা মৌসুমে পানির প্রবাহ বেশি থাকায় জমা পানি অনেক সময় নামতে দেরি হয়। বাড়ে ডেঙ্গুর মতো রোগের উপক্রম।

আশঙ্কা করা হচ্ছে, আসন্ন বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হলে জলাবদ্ধতায় আরও নাকাল হবে নগরবাসী। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনে এখনও কাজ শুরু করেনি। এখন সম্ভাব্য জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকাগুলোর ড্রেন, নালা, খাল পরিষ্কারে কাজ করতে হবে জোরেশোরেই। সরকারের সব ধরনের সহযোগিতায় ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটি করপোরেশন যথাযথ ভূমিকা পালন করবে—এটাই নগরবাসীর প্রত্যাশা।

বৃষ্টির পানি জমে শুধু ভোগান্তি নয়, মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। দুই বছর মিরপুরে কমার্স কলেজ সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশের রাস্তায় বৃষ্টিতে জমা পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে একই পরিবারের চারজন মারা যান। এ ঘটনার পর ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলেও বর্ষাকাল যেতেই মানুষ ভুলে গেছে। সেই জলাবদ্ধতারও কোনো সুরাহা হয়নি।

বর্ষায় নোংরা পানি ও কাদার কারণে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়াও কষ্টকর। বৃষ্টিতে রাজধানীর অনেক এলাকায় কোমর ও বুক সমান পানি জমে যায়। একাধিক এলাকায় শিশু-কিশোরদের জমে থাকা পানিতে সাঁতার কাটতে দেখা যায়।

অপরিকল্পিত নগরায়ণের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো ঢাকা শহর। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের খালগুলো দখল করে বাড়ি, মার্কেট, রাস্তা নির্মাণ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য থাকা নিম্নাঞ্চলগুলো ভরাট করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা, পুকুর, জলাশয়, উন্মুক্ত স্থান ভরাট করে শহরকে কংক্রিটের আবরণে ঢেকে ফেলা, দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, আর সেই সঙ্গে ঢাকা শহরের রাস্তায়, ড্রেনে ও খালে যত্রতত্র ময়লা ফেলায় অভ্যস্ত ঢাকাবাসী। একটি নগরী জলাবদ্ধ হওয়ার সব কারণই এখানে বিদ্যমান।

বৃষ্টির পানি ও ময়লা পানি পরিবহনের জন্য ঢাকা শহরের মাটির নিচ দিয়ে যে ড্রেনেজ লাইনগুলো রয়েছে সেগুলোর মাধ্যমে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হয়ে শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত খালগুলোয় গিয়ে পড়ার কথা। খালগুলোর মাধ্যমে সেই পানি নদীতে নিষ্কাশন হওয়ার কথা। চারদিকে পাঁচটি নদী দিয়ে ঘেরা ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে একসময় ৫০টির অধিক খাল, বেশ কয়েকটি লেক, পুকুর ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য কিছু নিচু এলাকা ছিল। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে খালের জায়গা দখল করে বাড়ি, মার্কেট, রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করায় বেশ কয়েকটি খাল অস্তিত্ব হারিয়েছে, বাকিগুলো সরু নালায় পরিণত হয়েছে।

সার্বিক বিষয় নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। নিয়ম মেনে সঠিক কার্যক্রম হিসেবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্তমানে এসব কাজের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের, তাই তাদের অন্যদের ওপর দোষ চাপানোর কোনো সুযোগ নেই। কাজের সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন তাদেরই করে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতার সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে হবে।’

কালের আলো/এমএএইচএন