বাজেট ২০২৫-২৬: বরাদ্দ কমালে চুরি কমে?
প্রকাশিতঃ 1:48 pm | May 21, 2025

মোস্তফা কামাল:
পর্যাপ্ত অর্থ থাকলে খরচ বাড়ানো-কমানো এক বিষয়। না থাকলে খরচ বাড়ানো বাতুলতা। তখন খরচ কমাতেই হয়। তা ঘর-সংসারেও, দেশের বাজেটেও। তখন কৃচ্ছ্রতার কথা আসে। আমাদের মতো দেশে সচরাচর রাজনৈতিক সরকারগুলোর রাষ্ট্রের খরচ বাড়ানো, মেগা প্রজেক্ট নেয়ার বাহাদুরির পেছনে থাকে চুরি-লুটপাট, বিশেষ করে দলীয় লোকদের টাকা হাতানোর ব্যবস্থা করা। দুর্নীতির সুযোগ করে দেয়া। পাকা চোরেরা কম টাকা থেকেও বেশি সরানোর বুদ্ধি রাখে। তা ঘরে-বাইরে, সমাজে-রাষ্ট্রে বহু প্রমাণিত। মাইক্রো-ম্যাক্রো মিলিয়ে মেগাকাণ্ড করার হিম্মতবান লোকের অভাব নেই চারদিকে।
বর্তমান সরকার একদিকে নির্দলীয়। আরেকদিকে সকৃচ্ছ্রতার র্বদলীয়। এটি সবার পছন্দের সরকার। সেক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক অভিলাষ বা দলীয় লোকদের মোটাতাজা করার অ্যাজেন্ডা না থাকাই স্বাভাবিক। বিগত সরকারের নানা মেগা প্রজেক্ট নেয়ার সমালোচনাও করছেন এ সরকারের উপদেষ্টারা। আবার মেগা প্রজেক্টের দিকে ঝোঁকার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। বড় প্রজেক্টের জন্য চাই বড় অঙ্কের টাকা। কিন্তু টাকা কোথায়? রাজস্ব বাজেট থেকে কোন টাকা উন্নয়ন বাজেটে দেয়া যায় না। উন্নয়ন কর্মসূচির সবটাই দেশি-বিদেশি ঋণ করে করতে হয়। এর জন্য রাজস্ব আয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যায় সুদাসল শোধ করতে।
তাহলে বড় উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হবে কীভাবে? পিপিপি’র মাধ্যমে? বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি বা ডোনার কান্ট্রির দেয়া ঋণে? সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের মাধ্যমে? সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট মানে দুর্নীতির ডিপো। পাঁচ টাকার জিনিস দশ টাকায় কেনা। নিতান্ত দায়ে না পড়লে পৃথিবীর সভ্য কোন দেশ এখন আর এভাবে ঋণ নেয় না। দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারগুলোরই সেদিকে নজর থাকে বেশি। অর্থনীতির নাড়িনক্ষত্র না জানা ব্যক্তিও অবগত, রাজনীতি-কূটনীতির পাশাপাশি দেশ মারাত্মক অর্থ কষ্টেও ভুগছে। তাই খরচ কমানো বা কৃচ্ছৃতার প্রশ্ন। সঙ্গতকারণেই উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারের আগামী অর্থবছরে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা কমানোর পরিকল্পনা। তেমন কোনো খাতই বাদ যাচ্ছে না এ কাটছাঁট থেকে। তা জরুরি খাত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যেও।
বাজেট ব্যয়ের ভাগ দুটি। একটি উন্নয়ন ব্যয় বা এডিপি, অন্যটি অনুন্নয়ন ব্যয়। সার্বিকভাবে বাজেটে কোন খাত কতটা গুরুত্ব পেল, তা বোঝা যায় সামগ্রিক বরাদ্দ থেকে। রবিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ-এনইসির বৈঠকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি- এডিপি অনুমোদনের পর বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ কমানোর ব্যাখ্যা দিয়েছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ । এ অনুমোদন আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা কম। চলতি অর্থবছরে মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। পরে তা কমিয়ে আনা হয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুসারে, আগামী এডিপির অর্থের মধ্যে স্থানীয় উৎস থেকে জোগান দেওয়া হবে ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। আর প্রকল্প সহায়তা হিসেবে পাওয়া যাবে ৮৬ হাজার কোটি টাকা। আগামী এডিপিতে ১ হাজার ১৪২টি প্রকল্প। নতুন খসড়া এডিপিতে বরাদ্দের দিক থেকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৫৮ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৩২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ শিক্ষা খাতে ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। অন্য খাতগুলোর মধ্যে গৃহায়ন খাতে ২২ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা; স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ১৬ হাজার ৪৭২ কোটি; কৃষিতে ১০ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা; পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ খাতে ১০ হাজার ৬৪১ কোটি; শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবায় ৫ হাজার ৩৮ কোটি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে ৩ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা।
চুরি-দুর্নীতি কমাতে ও বাস্তবায়নযোগ্য করতে ব্যয়বরাদ্দ কমাতেই হবে। কিন্তু সব খাতে কমিয়ে দেয়া সুনীতি নয়। ব্যয়বরাদ্দ কমালে চুরি-দুর্নীতি কমবে বা কমেছে সেই রেকর্ড নেই। ব্যয়-বরাদ্দের অঙ্ক বলছে, সরকারের অগ্রাধিকার আগের মতোই রয়ে গেছে। চুরি-বেহাতের পাশাপাশি কোনো কোনো খাতে বরাদ্দ খরচ না হয়ে পড়ে থাকার নজিরও রয়েছে বিভিন্ন সময়ে। চুরি কেন হয় বা বরাদ্দ কেন ব্যয় হয় না?-এ প্রশ্নের নিষ্পত্তিও হয় না।
বরাদ্দ কমানোর যুক্তিতে বলা হয়েছে উন্নয়ন বাজেটকে দুষ্টু চক্র থেকে বের করে আনার চেষ্টার কথা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পর এ সরকারের প্রথম বাজেট ঘোষণা হবে ২ জুন। অপেক্ষা আর সামান্য কয়েকদিনের। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেও বোধগম্য যে, চুরি-দুর্নীতি কমাতে ও বাস্তবায়নযোগ্য করতে ব্যয়বরাদ্দ কমাতেই হবে। কিন্তু সব খাতে কমিয়ে দেয়া সুনীতি নয়। ব্যয়বরাদ্দ কমালে চুরি-দুর্নীতি কমবে বা কমেছে সেই রেকর্ড নেই। ব্যয়-বরাদ্দের অঙ্ক বলছে, সরকারের অগ্রাধিকার আগের মতোই রয়ে গেছে। চুরি-বেহাতের পাশাপাশি কোনো কোনো খাতে বরাদ্দ খরচ না হয়ে পড়ে থাকার নজিরও রয়েছে বিভিন্ন সময়ে। চুরি কেন হয় বা বরাদ্দ কেন ব্যয় হয় না?-এ প্রশ্নের নিষ্পত্তিও হয় না।
অর্থনীতি বিশেষ করে উন্নয়নের নিজস্ব একটা গতি-বৈশিষ্ট্য থাকে। সেখানে বেশি জোরজবরদস্তি অনেক সর্বনাশ করে দেয়। দেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি মাথায় রেখেই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট করতে হচ্ছে সরকার। কতোটা সফল বা ব্যর্থ হবে, সেটা আরো পরের বিষয়। তার আগে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের বিষয় রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগের অনেক আশ্বাস রয়েছে। কিন্তু, তা সময়ের ব্যাপার। তা নির্ভর করছে সামনের পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর। দেশি বিনিয়োগকারীরা রয়েছে ট্রমার মধ্যে। তা কাটানোর স্পষ্ট উদ্যোগ নেই। এসবের ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। দেশের অর্থনীতির ওপরে যে ঝড়ঝাপটা গেছে তা কাটানোর পাশাপাশি সামনের পথরেখা ঠিক করা যেনতেন কাজ নয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নানা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সামনের পরিস্থিতি কী হবে? ওই পরিস্থিতি এ সরকারের বাজেটের সঙ্গে খাপ খাবে কি-না; তাও ভাবনার বিষয়।
সঙ্গত নানা কারণেই অন্তর্বর্তী সরকার রাজস্ব খাতে গতি আনতে পারেনি। তা সামলাতে গিয়ে কাগজের টাকা ছাপানোর সস্তা কাজও করেনি সরকার। ব্যাংকখাতে আগের অনেক অব্যবস্থাপনা দূর করতে পেরেছে। সেইসাথে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে প্রচুর টাকা ঋণ নিয়েছে। সঞ্চয়পত্র থেকেও বেশি সুদে প্রচুর ঋণ নিয়েছে। তা টানতে হচ্ছে। এ সুদ মেটাতে বাজেটে বড় অঙ্ক রাখতে হচ্ছে। সামনের সরকারকে এর জের টানতে হবে। তারপরও দুর্নীতি-চুরির লাগামে টান পড়লে এ জের টানা ও বরাদ্দ কমানোর কিছু সুফল আশা করা যায়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।