পাচারের অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে বহুমুখী কৌশলে সরকার
প্রকাশিতঃ 10:34 am | May 21, 2025

কারের আলো রিপোর্ট:
পতিত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছিল ব্যাংকিং খাত। যার কারণে ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ১১টি দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল। দেশে ৬১টি ব্যাংকের প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও হাসিনার খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে তাঁর আত্মীয়স্বজন, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও অলিগার্ক ব্যবসায়ী ও ‘রবার ব্যারনে’ পরিণত হওয়া লুটেরাদের পুঁজি লুণ্ঠনের অবিশ্বাস্য সুযোগ করে দেওয়ার জন্য এতগুলো ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। গত ৫ আগস্ট হাসিনার স্বৈরশাসনের উৎখাতের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর একের পর এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাংকিং খাতকে গিরিখাতে পতনের কিনারা থেকে উদ্ধারের মিশন চালিয়ে আসছে।
পাচারের অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সরকারও বহুমুখী কৌশল নিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের আইন, অবকাঠামোগত দুর্বলতা আছে, এমন স্থানে দ্রুত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এর মধ্যে নতুন আইন করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে পাচারের অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার নতুন আইনি বিধান রাখা হচ্ছে। সোমবার (১৯ মে) ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, দেশের ব্যাংক খাত থেকে লুটপাটের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া চলছে। বিদেশে পাচার করা অর্থ-সম্পদ ব্যবহারের জন্য একটি ম্যানেজমেন্ট ফান্ড গঠন করা হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) ও সরকার গঠিত যৌথ তদন্ত দলের সমন্বিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাচার করা টাকা শনাক্ত ও ফেরানোর ক্ষেত্রে দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দ্রুত সমাধানের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে প্রতিবেদনটি পাচারসংক্রান্ত বিষয়ে যেসব সংস্থা কাজ করছে তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পাচারের টাকা শনাক্ত ও ফেরানোর কাজে নিয়োজিত সংস্থাগুলো কাজ করতে গিয়ে ১১ ধরনের প্রধান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। এর মধ্যে পাচারের টাকা শনাক্ত ও ফেরানোর কাজে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা প্রকট। এক সংস্থা অন্য সংস্থার কাছে সব তথ্য দিচ্ছে না।
দক্ষ ও জনবল সংকটের দোহাই দিয়ে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করছে না তদন্ত কাজে। অনেক সংস্থা তদন্ত কাজে শিথিলতা দেখাচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য মানি লন্ডারিং প্রতিরোধবিষয়ক জাতীয় সমন্বয় কমিটি, ওয়ার্কিং কমিটিকে নিয়মিত সভা করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে নিজেদের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব কাজে আন্তঃসংস্থাবিষয়ক কোনো কার্যক্রম হাতে নিতে হলে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের মাধ্যমে সমন্বয় সাধনের পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। পাচারবিষয়ক সেন্ট্রাল অথরিটির সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তদন্তকারী সংস্থাগুলোর অধিকতর সমন্বয় সাধনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় নির্দিষ্ট কর্মকাণ্ডে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, টাকা কীভাবে ফেরত আনতে হয় সেটার কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের নাই। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল এক্সপেরিয়েন্সটা আমরা জানি। সাধারণত এটি করতে চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে। কিন্তু এর মধ্যে ইমিডিয়েট কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যায়। বিদেশে তাদের যে সম্পদ আছে সেটাকে ফ্রিজ করা যায়। সেটা আপেক্ষিকভাবে বছরখানেকের মধ্যেই করা সম্ভব। প্রথমে আইনের প্রক্রিয়াটা আমাদের দেশের সম্পন্ন করতে হবে। তারপরে সঠিক প্রণালীতে বিদেশে রিকুয়েস্ট করতে হবে। যেটাকে বলা হয় মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্টেন্স (এমএলএ)। আমরা এখন এই প্রক্রিয়াতে আছি। আমরা রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছি। তিনি বলেন, দেশের ব্যাংক খাত থেকে লুটপাটের মাধ্যমে অনেকে টাকা বিদেশে পাচার করেছে। আবার দুর্নীতির মাধ্যমেও টাকা অর্জন করেও টাকা পাচার করেছে। দেশে এদের কিছু সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এসব সম্পদ ব্যবহারের জন্য একটি ম্যানেজমেন্ট ফান্ড গঠন করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, পাচারসংক্রান্ত তথ্য নিয়ে বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিএফআইইউ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও সিআইডি কাজ করছে। সংস্থাগুলো পাচারসংক্রান্ত যেসব তথ্য পাচ্ছে সেগুলো নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কাছেই রাখছে। ফলে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রয়োজনীয় তথ্য মিলছে না। এ সমস্যা সমাধানে সব সংস্থার পাচার করা সম্পদের তথ্য ও ফেরানোর কাজের অগ্রগতিসহ সব ধরনের পদক্ষেপ ও জটিলতার বিষয়গুলো বিএফআইইউতে থাকবে। এজন্য বিএফআইইউতে একটি তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা হবে। এই ভান্ডার থেকে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো যথাসময়ে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারবে। এতে কার্যক্রমে গতি আসবে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশে অর্থ পাচারসংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে পাওয়া একটি বড় সমস্যা। কারণ সব দেশের আইনই আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষার পক্ষে। যে দেশে টাকা পাচার করা হয় ওই দেশে পাচারকারী আমানতকারী হিসাবে সুবিধা পাচ্ছেন। এছাড়া পাচারকারীর সঠিক নাম, ঠিকানা পাওয়াও একটি সমস্যা। এসব কারণে পাচার করা অর্থ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে এগমন্ট গ্রুপের (মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রম নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা) সব সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বিএফআইইউ কর্তৃক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশ্বের ১৭০টি দেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট এগমন্ট গ্রুপের সদস্য। ফলে এদের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট তথ্য চাইলে ১৭০টি দেশ থেকেই তথ্য পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এখন পর্যন্ত ৮১টি দেশের সঙ্গে বিএফআইইউর সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে এর মধ্যে যেসব দেশে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে ওইসব দেশ নেই।
কালের আলো/এমএএইচএন