নিহত ক্যাডেট ও নাবিকদের পরিবারে মুক্ত ঝরা হাসি ফুটানোর অনবদ্য প্রয়াস বিএসসি’র, দৃষ্টান্ত মেরিন কমিউনিটির জন্যও
প্রকাশিতঃ 10:20 pm | May 20, 2025

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
ডেক ক্যাডেট সৌরভ কুমার সাহা, হাইলি স্কিল্ড অটোমেকানিক মো. নুরুল ইসলাম, দৈনিক ভিত্তিক ফিটার হারুন অর রশিদ ও মো. সাদিক মিয়া। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে কর্মরত ছিলেন তাঁরা। জীবন জয়ের দুয়ারে এসে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ও ৫ অক্টোবর এম.টি বাংলার জ্যোতি ও এম.টি বাংলার সৌরভ জাহাজে অগ্নি দুর্ঘটনায় চিরতরে নিভে যায় তাদের প্রাণ প্রদীপ। সঙ্গে সঙ্গে ধূলিসাৎ হয় চার পরিবারের সুখের মুখ দেখার তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নের পাহাড়। সহকর্মীদের হারিয়ে শোকের ছায়া নেমে আসে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনেও। আজও তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত চিরপ্রস্থানের শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি পরিবারের সদস্যরা। স্বজন হারানোর বেদনায় ডুকরে কাঁদে তাঁরা।
পরিবারের উপার্জনক্ষম এসব ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ায় বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)। দুর্ঘটনার পরপরই তাৎক্ষণিক প্রাথমিকভাবে চারটি পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। কিন্তু দুর্মূল্যের বাজারে সংযমী হয়েও এই টাকায় জীবন-সংসার পরিচালনা অসম্ভবই বটে! ধূসর স্বপ্নগুলোকে তাই রাঙিয়ে; ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নকে পুনরুজ্জীবিত করতে আন্তরিক সদিচ্ছার প্রাবল্যেই আর্থিক সহায়তার চিরায়ত প্রথাগত গণ্ডি পেরিয়ে মুক্ত ঝরা হাসি ফুটানোর নতুন এক প্রয়াস গ্রহণ করে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন।
নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড.এম সাখাওয়াত হোসেন এর সার্বভৌম মানবিক মানসিকতায় জাহাজ দুটিতে অগ্নি দুর্ঘটনায় নিহত ক্যাডেট ও নাবিকদের প্রত্যেক পরিবারকে ৩০ লক্ষ টাকা করে চারটি পরিবারকে মোট এক কোটি ২০ লক্ষ টাকার আর্থিক সহায়তার চেক তুলে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বিএসসিকে একটি অখণ্ড পরিবার হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কমডোর মাহমুদুল মালেক এর সৌম্য ও হৃদয়বান মানসিকতাও মোটাদাগে প্রতীয়মান হয়েছে। পরিবারগুলোর সদস্যরা যাদের হারিয়েছেন, তাঁরা ফিরবে না আর কোনদিন। প্রিয়জনের জন্য বুকের ভেতর স্বভাবতই মোচড় দিয়ে ওঠে স্বজনদের। চোখের কোণ জল ঝলমল করলেও সংবিৎ ফিরে পেতেই ফিক করে সামান্যতম স্বস্তির আভাস! আর্থিক সহায়তা পাওয়া স্বজনদের কাছে বিএসসি’র এই সহায়তা এখন বেঁচে থাকার বড় এক অবলম্বন।
ওদের জীবনে অনিশ্চয়তার মেঘ কেটে এখন উজ্জ্বল রোদ্দুর, দৃষ্টান্ত মেরিন কমিউনিটিতেও
মঙ্গলবার (২০ মে) বেলা ১২টায় রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়ে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) টাওয়ারে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি নিহত পরিবারের সদস্যদের জীবনের অনিশ্চয়তার কালো মেঘ তাড়িয়ে সন্ধান দিয়েছে উজ্জ্বল রোদ্দুরের। মনচৈতন্যে বিরহ ছায়া ফেললেও তাদের চোখেমুখে ঝলমল করেছে আনন্দ। তাঁরা নৌপরিবহন উপদেষ্টা ও বিএসসি’র এমডি’র প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড.এম সাখাওয়াত হোসেন ছাড়াও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ ও বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক উপস্থিত ছিলেন।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রয়াত হাইলি স্কিল্ড অটোমেকানিক মো. নুরুল ইসলামের স্ত্রী শামীমা আক্তার কণা কথা বলেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জীবন থেকে সব আনন্দ হারিয়ে গেছে। এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে অনিশ্চয়তার এক জীবন আমাদের। আলহামদুলিল্লাহ দারিদ্র্যের কশাঘাতের জীবনে বিএসসি’র এই সহায়তা আমাদের জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে। তাঁরা আমাকে আউটসোর্সিংয়ে চাকরিরও ব্যবস্থা করেছে।’
ঠিক পাশের আসনে বসে থাকা প্রয়াত ডেক ক্যাডেট সৌরভ কুমার সাহার বাবা মানিক সাহা এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিএসসি’র কাছে অনুরোধ ছিল আমাদের জন্য চলার মতো সহায়তা করা হয়। তাঁরা আমাদের কথা দিয়েছিলেন আমাদের পাশে থাকবেন। তাঁরা কথা রেখেছেন। তাদের এই সহায়তা আমাদের অসহায় জীবন-যাপনের যন্ত্রণা লাঘবে সহায়তা করবে।’
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) জানায়, ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের এম.টি বাংলার জ্যোতি জাহাজ ডলফিন জেটিতে অবস্থানকালে আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় করপোরেশনের ডেক ক্যাডেট সৌরভ কুমার সাহা, হাইলি স্কিল্ড অটোমেকানিক মো. নুরুল ইসলাম, দৈনিক ভিত্তিক ফিটার হারুন অর রশিদ নিহত হন। একই বছরের ৫ অক্টোবর এম.টি বাংলার সৌরভ জাহাজের অগ্নি দুর্ঘটনায় মো. সাদিক মিয়া আহত হওয়ার পর চিকিৎসারত অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
নিহতদের পরিবারকে এক কোটি ২০ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা প্রদানকালে নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন আর্থিক সহায়তার চেক তুলে দিয়ে অগ্নি দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা ও সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার সবসময় তাদের পাশে রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের উপযুক্ত সদস্যদের কর্মসংস্থান ও পড়ালেখার বিষয়েও বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) সহযোগিতা করছে। তাছাড়া এই আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে বিএসসি মেরিন কমিউনিটির জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছে।’
বিএসসি সরকারের একটি লাভজনক সংস্থা, দুটি এলএনজি জাহাজ কেনার পরিকল্পনা
দ্রুত বিকশিত হচ্ছে বাংলাদেশের শিপিং খাত। এই সময়টিতে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) বহরের সক্ষমতাও বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের শিপিং শিল্পে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে দক্ষ নেতৃত্ব ও সঠিক পরিকল্পনায় ঘুরে দাঁড়াচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই সংস্থাটি। চেষ্টা চলছে বিএসসি’র জাহাজের বহর আরও বড় করার। শুধু তাই নয় গত ৫৩ বছরে সর্বোচ্চ মুনাফা আয়ের একটি বিরল রেকর্ডও গড়েছে তাঁরা। গত বছরের জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা মুনাফা করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সবাইকে। একই সঙ্গে শেয়ার হোল্ডারদের বদৌলতে সরকারকে পৌঁনে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ ফেরত দিয়ে নিজেদের সক্ষমতারও পরিচয় দিয়েছে বিএসসি। অতীতে বাংলাদেশের সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের এমন নজির নেই। স্বভাবতই এই ধরনের ঘটনাকে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবেই মনে করা হচ্ছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন এজন্যই বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনকে (বিএসসি) সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক সংস্থা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর্থিক সহায়তা প্রদান অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা বলেন, ‘বিএসসি মেরিটাইম সেক্টরের উন্নয়নের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকমানের শিপিং সেবা দেওয়ার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এটির কার্যক্রম আরও বিস্তৃত ও লাভজনক করতে দুটি এলএনজি জাহাজ কেনার পরিকল্পনা রয়েছে।’
কালের আলো/এমএএএমকে