কার ভুলে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগ ঠেকাতে পারেনি এসবি?

প্রকাশিতঃ 10:05 pm | May 10, 2025

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের  আলো:

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় টানা দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকা আবদুল হামিদের দেশত্যাগ নিয়ে এখনও বিতর্ক চলছে। ঘটনার তিনদিন পরেও এ নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, চলছে নানা রকম বিশ্লেষণ। এ ঘটনায় কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার (বর্তমানে প্রত্যাহারকৃত) গত ২৬ জানুয়ারি এক গোপনীয় জরুরি বার্তায় রাজধানীর রাজারবাগে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) সদর দপ্তরে আবদুল হামিদসহ ৪৫ জনের একটি তালিকা পাঠিয়ে তাদের দেশত্যাগ ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন-এই সংক্রান্ত একটি চিঠি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর বিতর্কের পালে নতুন করে হাওয়া লেগেছে।

অনেকেই বুঝে না বুঝে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) প্রধান মো.গোলাম রসুলকে তোপ দাগছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাবেক রাষ্ট্রপতির ইমিগ্রেশন পার হওয়ার ক্ষেত্রে এসবি প্রধানকে ইঙ্গিত করে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে তার সত্যতা যাচাই করতে বিস্তারিত খোঁজ নিয়েছে কালের আলো। এক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সামনে এসেছে। যেসব তথ্যে প্রতীয়মান সাবেক রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে দেশত্যাগে কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না। এ বিষয়ে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষও ইতোমধ্যে নিজেদের বক্তব্য স্পষ্ট করেছে।

এসবির ইমিগ্রেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে রেকর্ড ছিল না মামলার তথ্য
কিশোরগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও গুলি করার ঘটনায় সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে আসামি করে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ সদর থানায় তহমুল ইসলাম মাজহারুল বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) দায়িত্বশীল সূত্র কালের আলোকে জানায়, এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে কোন রিকুইজিশন পাঠাননি। ফলে তাঁর দেশত্যাগে আদালতের কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না। সরকারিভাবে অনুরোধের পরেও কিশোরগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী আদালতের নির্দেশে মামলার বিবরণ এসবির ইমিগ্রেশন শাখায় পাঠাননি। এর ফলে ইমিগ্রেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে এই সংক্রান্ত বিস্তারিত কোন তথ্য রেকর্ড ছিল না। ইমিগ্রেশন সিস্টেমে রেকর্ড থাকলেও তাঁর বিদেশযাত্রা আটকে দেওয়া সম্ভব হতো। এছাড়া কোন গোয়েন্দা সংস্থার আপত্তি না থাকার কারণে আবদুল হামিদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হয়।

বিভিন্ন সূত্র কালের আলোকে আরও জানায়, লাল পাসপোর্ট ব্যবহার করে চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে গেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে সাবেক রাষ্ট্রপতির ব্যবহৃত লাল পাসপোর্টের নম্বর কোড ছিল ডি। ডি’তে ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট বুঝানো হয়। বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের (ডিআইপি) সূত্র মোতাবেক, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ লাল পাসপোর্ট বহন করছেন। তার পাসপোর্টটি বন্ধ করার বিষয়ে মন্ত্রনালয় বা আদালত থেকে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিরাগমন শাখা-১ থেকে জারি করা পরিপত্র অনুযায়ি চতুর্থ ব্যক্তি হিসেবে সাবেক রাষ্ট্রপতি (অবসর জীবন যাপন ও পেনশনভোগী) লাল পাসপোর্ট পেয়ে থাকেন। ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট ব্যবহার করে তিনি থাইল্যান্ডে যাওয়ায় এবং সরকার সেটি বাতিল না করায় কোন অবস্থাতেই পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) তাকে আটকাতে পারেনি।

এ ঘটনায় পুলিশের মাঠ পর্যায়ের চার কর্মকর্তাকে শাস্তির আওতায় এনেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। একই সঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তর অতিরিক্ত আইজিপিকে (প্রশাসন) মতিউর রহমান শেখকে প্রধান করে তিন সদস্যের ইনকোয়ারি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ইতিমধ্যে কার্যক্রমও শুরু করেছে।

এসবি প্রধান কী সত্যিই ফ্যাসিস্টের দোসর?
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে টানা দু’বার রাষ্ট্রপতি ছিলেন আবদুল হামিদ। স্বভাবতই তাঁর দেশত্যাগে রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষোভ-অসন্তোষ তৈরি করেছে। অনেকেই পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) প্রধান মো.গোলাম রসুলকে এ ঘটনায় সম্পৃক্ত করে তাকে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ তকমা দিয়েছেন। পাশাপাশি পুলিশে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ পরিকল্পনাও না কী তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত এমনটিও বলাবলি হচ্ছে। যদিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এসব তথ্যের কোন রকম সত্যতা পাওয়া যায়নি।

কালের আলো খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে, বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ১২তম ব্যাচের (১৯৯১) কর্মকর্তা মো. গোলাম রসুল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পদে পদে বঞ্চিত ছিলেন। তাঁর জুনিয়ররা অনেক আগেই পদোন্নতিসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসীন হলেও তাঁর ভাগ্যে শিকেয় ছিঁড়েনি। ভিন্ন মতাদর্শের অভিযোগে তাকে বারবার পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়। ২০০৬ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চের বিশেষ পুলিশ সুপার ছিলেন। প্রায় ১৩ বছর তিনি অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ স্টাফ কলেজে দায়িত্ব পালন করেন। জুনিয়র পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ এর মতো নীতি নির্ধারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, অনভিপ্রেত ও কল্পনাপ্রসূত। ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার বঞ্চিতদের মূল্যায়ন করে পদোন্নতি দিয়েছে। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবেই এই তালিকায় ঠাঁই পান গোলাম রসুল। গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর থেকে ডিআইজি হিসেবে এসবির ভারপ্রাপ্ত প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। চলতি বছরের সোমবার (১৩ জানুয়ারি) তাকে অতিরিক্ত আইজি করে এসবি প্রধানের চলতি দায়িত্ব দেওয়ার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তখন তাকে নিয়ে কোন কথা না থাকলেও এখন আবদুল হামিদের ঘটনায় তাকে নিয়ে অপপ্রচার অনেক রহস্য ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

কালের আলো/আরআই/এমকে