বাংলাদেশ পুলিশের নবযাত্রায় শুভ্র সুন্দরের বারতায় নাগরিকদের প্রাণবন্ত মিলনমেলা
প্রকাশিতঃ 11:42 pm | May 01, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
গত বছরের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের আগে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি ও অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে সবার চক্ষুশূল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ পুলিশ। সরকার পতনের পর জনরোষে থানাগুলো পরিণত হয় ধ্বংসস্তুপে। লুট হয় আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ। এরপর পুলিশে নেতৃত্ব পরিবর্তনের পর শুরু হয় ঘুরে দাঁড়ানোর ‘যুদ্ধ’। ভেঙে পড়া মনোবল ফিরে পেতে কঠিন এক সংগ্রাম। বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনীর খোলনলচে বদলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অতীতের দুর্নাম ঘুচিয়ে বাহিনীটির জনআস্থা অর্জনে গভীর মনোযোগ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর দিকনির্দেশনায় পুলিশ সদস্যদের মনোবল ফেরানো ও নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করতে কাজ করে চলেছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। কঠিন এই বাস্তবতার মধ্যেই ‘আমার পুলিশ আমার দেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’-প্রতিপাদ্য নিয়ে এবার অনুষ্ঠিত হয়েছে চলতি বছরের পুলিশ সপ্তাহ।
প্রতি বছর সপ্তাহব্যাপী আয়োজন থাকলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবার মাত্র তিনদিনেই শেষ হয়েছে সব আয়োজন। বিশেষ করে বৃহস্পতিবার (০১ মে) প্রথমবারের মতো এই পুলিশ সপ্তাহে নাগরিকদের জন্য নতুন মাত্রার একটি আয়োজন করে বাংলাদেশ পুলিশ। এদিন দুপুরে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়ামে ‘নাগরিক ভাবনায় জনতার পুলিশ : নিরাপত্তা ও আস্থার বন্ধন’ শীর্ষক মতবিনিময় সভাটিকে ঘিরে ছিল স্বভাবতই উৎসবমুখর এক পরিবেশ। দুর্গম পথ পেরিয়ে যেন অপার সম্ভাবনায় স্বপ্নের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া। প্রীতি উজ্জ্বল নির্মল জীবনে শুভ্র সুন্দরের বারতায় নাগরিকদের প্রাণবন্ত এক মিলনমেলা। মৈত্রী ও সম্প্রীতির যেন এক উদার মিলনক্ষেত্র! ঠিক যেন বাংলাদেশ পুলিশের নবযাত্রা। যেখানে দেশের বিশিষ্টজনরা বাংলাদেশ পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত জনতার পুলিশ হিসেবে দেখতে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন।
নিজেদের পরিবর্তনে একাট্টা হওয়ার শপথে অনন্য মহিমাময় এই দিনটিতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী, প্রথিতযশা চিন্তাবিদ ও লেখক অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান, নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবির, এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্ট্যাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সাজ্জাদ সিদ্দিকী, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য অধ্যাপক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য ডা. জাহেদ উর রহমান, সাবেক আইজিপি মো. আব্দুল কাইয়ুম, সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ বিন কাশেম, বিশিষ্ট আইনজীবী মানজুর আল মতিন, সঙ্গীতশিল্পী আসিফ আকবর, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, বিশিষ্ট গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরাজী, নির্মাতা ও পরিচালক আশফাক নিপুণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ নতুন স্বপ্নে, নতুন সাহস ও অঙ্গীকারে ‘জনতার পুলিশ’ গড়তে প্রতিটি পুলিশ সদস্য নিজেদের আন্দোলিত করেছেন প্রবলভাবেই। মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ, বাংলাদেশ বাহারুল আলম বিপিএম। সমাপনী বক্তব্য রাখেন নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা সংক্রান্ত উপ-কমিটির সভাপতি ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত আইজি গোলাম রসুল। বাংলাদেশ পুলিশের নবযাত্রার এই মাহেন্দ্রক্ষণে দেশবাসীর আকুন্ঠ সমর্থন আর পুলিশ-জনতার হৃদয় দিয়ে হৃদয় কেনার বার্তাও ধ্বনিত হয়েছে নিজেদের অবিনাশী চেতনার মর্মমূলে।
এই সংলাপ পুলিশ সপ্তাহের একটি নতুন সংযোজন ও নতুন ভাবনা
‘নাগরিক ভাবনায় জনতার পুলিশ : নিরাপত্তা ও আস্থার বন্ধন’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। তিনি বলেন, ‘আজকের এই সংলাপ পুলিশ সপ্তাহের একটি নতুন সংযোজন ও নতুন ভাবনা। মূলত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী প্রেক্ষাপটে এই আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। পুলিশ নাগরিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, তাঁরা কেমন পুলিশ চান এসব বিষয় আরেকটু ভালোভাবে জানতে চাই আমরা। পুলিশ সম্পর্কে নাগরিক ভাষ্য ও নাগরিক প্রত্যাশা আমরা জানতে চাই। আমরা জানি, রবার্ট পিল ১৮২৯ সালে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ গঠন করেন। এর আগের পুলিশী কার্যক্রম ব্রিটিশ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। পুলিশের কাছে নাগরিকদের কাছে স্বত:স্ফূর্ততা বা নাগরিক অংশীদারিত্ব ছিল না। নাগরিকদের আস্থা ছিল অনেক কম। অনেকেই মনে করতেন আইন প্রয়োগকারী ব্যক্তিরা নিজেদের সুবিধার জন্য কাজ করে। পুলিশ একধরনের কর্তৃত্ববাদী আচরণে অভ্যস্ত ছিল ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের প্রতি আস্থা কমে গিয়েছিল। রবার্ট পিল এসব শৃঙ্খলা ও দুর্নীতির অবসান ঘটিয়ে একটি পেশাদার, নিয়মিত ও জনসেবামূলক পুলিশ বাহিনী গঠনের মাধ্যমে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসেন। তাঁর ই ইলিয়ান প্রিন্সিপালস বলে পরিচিত নীতিগুলোর মধ্যে জোর দেওয়া হয় পুলিশ জনগণের মধ্যে থেকে জনগণের জন্য কাজ করবে।
- পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত জনতার পুলিশ হিসেবে দেখতে গুরুত্বপূর্ণ মতামত
- এই সংলাপ পুলিশ সপ্তাহের একটি নতুন সংযোজন ও নতুন ভাবনা
- পুলিশের সঙ্গে জনতার বিভক্তির গোড়ায় যেতে হবে
- রাষ্ট্র যখন নিপীড়ক হয়ে ওঠে তখন পুলিশকে আর জনতার পুলিশ হয়ে উঠতে দেয় না
- পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে
- রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুলিশের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে
- সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কমিউনিটি পুলিশিং করতে হবে
- আমরা জনতার মুখোমুখি থাকবো না, পাশাপাশি থাকবো
আইজিপি নিজের বক্তব্যে আরও একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ টেনে বলেন, ‘১৯৩০ সালে ভারতবর্ষে লবণ আইন ভঙ্গ করার প্রতিবাদে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ‘লবণ মার্চ’ হয়। আন্দোলন ছিল একেবারেই অহিংস। কিন্তু ইন্ডিয়ান পুলিশ সদস্যদের ছিল ভিন্ন ভূমিকা। তাদের দায়িত্ব ছিল এই অহিংস আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করা। তৎকালীন দায়িত্বরত এক পুলিশ অফিসার তাঁর ডায়েরিতে লিখেন-‘আমি বেত্রাঘাত করেছি এমন মানুষের ওপরে যারা একটিবারও আমাদেরকে প্রতিরোধ করেনি। আমার হৃদয় ভেঙে গিয়েছে। আমি আজ বুঝেছি শক্তি নয় নৈতিকতা বড় অস্ত্র।’ তিনি বলেন, ‘ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে- অস্ত্র নয়, জনগণের আস্থা অর্জনই পুলিশের প্রকৃত শক্তি। পুলিশ যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের পাশে থাকে, তবে তারা ‘ভয়ের প্রতীক’ নয়, বরং হয়ে ওঠে ‘ভরসার আশ্রয়’। আজকের এই দিনে আমরা সবার কাছে এই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে চাই।’
পুলিশের সঙ্গে জনতার বিভক্তির গোড়ায় যেতে হবে
আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রথিতযশা চিন্তাবিদ ও লেখক অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান। তিনি বলেন, ‘পুলিশের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে। পুলিশের যে পজিশনে থাকার কথা ছিল সে পজিশনে নেই। পুলিশ যে আইনে চলে সেখানে পদে পদে সমস্যা আছে। এসব বিষয়ে মাঝেমধ্যে আলোচনা করা উচিত এবং খোলাখুলি আলোচনা হওয়া উচিত। পুলিশ শুধু রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ নয় পুলিশ সমাজের অংশ।’
দেশের প্রখ্যাত এই লেখক আরও বলেন, ‘পুলিশের অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার অভ্যাস আমার নেই। এটি নতুন ঘটনা বলা যায়। পুলিশ সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তাঁরা প্রস্তাব করেছেন অলটারেনেটিভস ফর দ্য পুলিশ। কিন্তু আমি প্রত্যাশা করেছিলাম অলটারনেটিভ টু দ্য পুলিশ। পুলিশের মধ্যে কী ভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কোন সমাজের জন্য আমি পুলিশের কাজের জন্য বলছি এবং যেসব সমাজে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিরাজ করে সেখানে পুলিশের কাজ কী?’
পুলিশের বলপ্রয়োগের কাজটি জনপ্রিয় নয় মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘আমি কোন বিতর্ক করতে এখানে দাঁড়াইনি। আমাদের দেশে পুলিশ যে আইনে চলছে সেটি ঔপনিবেশিক আইন। আমাদের সংবিধান আছে আমরা সেই সংবিধান অনুযায়ী চলি না। ২০২৪ স্মরণে আপনারা এই অভূতপূর্ব অনুষ্ঠান করছেন। কোন রাষ্ট্র জোরের ওপর টিকে থাকতে পারে না। জনসমর্থন যখন হিমাঙ্কের নিচে নেমে যায় তখন পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। পুলিশ কথার মধ্যে রাষ্ট্র কথাটি লুকিয়ে রয়েছে।’
ড.সলিমুল্লাহ আরও বলেন, ‘পুলিশ সমাজের অংশ। পুলিশের বিকল্প সিভিল সোসাইটি নয়। পুলিশের সঙ্গে জনতার বিভক্তির গোড়ায় যেতে হবে। এটি রাষ্ট্রের সঙ্গে জনতার বিভক্তি। এই রাষ্ট্র জনগণের রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারছে না। গণতন্ত্র বলতে আমরা স্বভাবতই বুঝি ৫ বছরের পর নির্বাচন। মানুষকে চিন্তায় উদ্ধৃত না করে সত্যকে আলিঙ্গন করার সাহস না দিয়ে তাকে শুধু মঙ্গল আর সুন্দরের আবরণে আচ্ছন্ন করে রাখে এটি ফ্যাসিবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি।’
রাষ্ট্র যখন নিপীড়ক হয়ে ওঠে তখন পুলিশকে আর জনতার পুলিশ হয়ে উঠতে দেয় না
নিউ এইজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবির বলেন, ‘বাংলাদেশের একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিকশিত হয়ে উঠবার জন্য প্রথম যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। সেই অর্থে পাকিস্তানিরা যখন প্রথম আক্রমণ এই রাজারবাগে পুলিশের ওপরই করেছিল। একটি সশস্ত্র জনযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের পরিস্কারভাবে অফিশিয়ালি যুদ্ধ শুরুর আগে তৎকালীন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ মানুষকে বলেছিল, পাকিস্তানকে তাড়িয়ে আমরা স্বাধীন দেশ তৈরি করবে। নতুন রাষ্ট্রের মূল নীতি হবে সমতাভিত্তিক সমাজ। যেখানে জাস্টিজ প্রতিষ্ঠিত হবে। নাগরিকের মর্যাদা সমুন্নত থাকবে। কিন্তু রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে নিপীড়নমূলক বৈশিষ্ট্য নিয়ে। রাষ্ট্র যখন নিপীড়ক হয়ে ওঠে তখন পুলিশকে আর জনতার পুলিশ হয়ে উঠতে দেয় না।’ তিনি বলেন, ‘পুলিশকে জনতার পুলিশ হতে হলে কতগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হবে। ন্যায় বা অন্যায় দেখার মত বুদ্ধিমত্তা থাকতে হবে।’
পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে
এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর পুলিশের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি ফিরে যান প্রায় ৩৫ বছর আগের ঘটনাপ্রবাহে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার জন্য এটি নতুন অভিজ্ঞতা। পুলিশের সামনে কথা বলার অভিজ্ঞতা প্রথম। আমি শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেবাখাতে কাজ করি। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে যখন সফিপুরে আমরা কাজ করি তখন পুলিশের কাছ থেকে নিরাপত্তা সহায়তা চেয়েছিলাম। কিন্তু তাদের কাছে কোন গাড়িই ছিল না। আমরা চারটি ফ্যাক্টরি তাদের টেম্পু ভাড়া করে দেই। ভাড়ার টাকাও কারখানাকে দিতে হতো। সেখান থেকে পুলিশের এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। আমরা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে পার্থক্য দেখি, আমরা শুনেছি রাস্তায় একজন ব্রিটিশ পুলিশকে দেখলে মানুষ সম্মান করে সালাম বা হ্যালো বলতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সেটি নেই।’
পুলিশের আস্থা বাড়াতে পুলিশ সার্ভিসে কারা যান এই ব্যাপারে আরও মনোযোগী হওয়াসহ তিনটি বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘কাকে পুলিশে নিচ্ছেন, কীভাবে ট্রেনিং দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে কী সেবা দেওয়ার মনোযোগ তৈরি করতে পারছি? এই বিষয়গুলো দেখতে হবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে সমতা। আমরা কী আইন সবার জন্য প্রয়োগ করি। বাংলাদেশে যারা ইনভেস্ট করে তারা বলে, বাংলাদেশে অনেক ল আছে কিন্তু অর্ডার নেই। আইনের সমান প্রয়োগ দেশে নেই। একজন পুলিশ অফিসার কী এটি প্রয়োগ করতে পারেন? তৃতীয় হচ্ছে শৃঙ্খলা। শিল্প পুলিশ এখন বাস্তবতা। এটি ছাড়া আমরা আমাদের কারখানা নিরাপদ রাখতে পারি না। শিল্প পুলিশও যখন আরেকজনের হাতিয়ার হয়ে যায় সেটি আমরা কীভাবে রোধ করবো? পুলিশকে সত্যি সত্যি স্বাধীনতা কি দিতে পারছি? আমরা আশা করবো এটি নিয়ে আপনারা কাজ করবেন। আপনারা যেন সমাজের জন্য কাজ করতে পারেন সেই জায়গাটি তৈরি করে দিতে হবে। তাঁরপর সেটি ধরে রাখার দায়িত্ব আপনাদের।’
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুলিশের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পুলিশের অপব্যবহার বন্ধ করার দাবি জানান সাজ্জাদ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘পুলিশ যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে তাহলে পুলিশের ইমেজ বাড়বে।’ অধ্যাপক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস বলেন, ‘পুলিশ যদি সত্যের পথে থাকে তাহলে ‘নতুন বাংলাদেশে’ তাদের আস্থার জায়গা হবে।’ তিনি বলেন, ‘পুলিশকে অসহায় মানুষের মাঝে দাঁড়াতে হবে।’ ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের অন্যায় আদেশ পালন থেকে বিরত থাকার জন্য পুলিশ সদস্যদেরকে লড়াই করতে হবে।’
সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কমিউনিটি পুলিশিং করতে হবে
সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কমিউনিটি পুলিশিং করতে হবে বলে মন্তব্য করেন সাবেক আইজিপি আব্দুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, ‘এত বড় পরিবর্তন হয়ে একটা গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেল। বাচ্চা ছেলেরা তারা তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছে তারা নতুন একটি বাংলাদেশ গড়তে চায়। একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীনতার পর। কিন্তু সঠিকভাবে আমরা এগোতে পারিনি আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এই যে একটা সম্ভাবনার ধার উন্মোচিত হয়েছে। অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেক স্বপ্ন এই স্বপ্ন যেন ব্যর্থ না হয়। সেজন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০০৯ থেকে ২৪ সাল পর্যন্ত আমরা যা দেখলাম তা কল্পনা ও ধারণা করা যায় না। গণতন্ত্র থাকলে যে সুবিধা হয় সেটা হচ্ছে যে পাঁচ বছর পর আপনাকে ভোটারদের কাছে যেতে হবে এবং মেন্ডেট নিতে হবে আপনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন না। ২০০৯ সালের নির্বাচনে যে খুব নিখুঁত হয়েছে তা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব না। তার পরবর্তী তিনটা নির্বাচনে যা হয়েছে তা আমরা সবাই জানি। যখন একচ্ছত্র ক্ষমতা এসে যায় তখন প্রশাসন ভেঙে পড়ে। এটা ভয় খুন-গুম ওর সন্ত্রাস দ্বারা সম্ভব হয়েছে। এ সময় শুধুমাত্র এক শ্রেণির পুলিশ কর্মকর্তা না সব সেক্টরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা অতি উৎসাহিত হয়ে কাজ করেছে। যা হবার হয়েছে আমাদের আবার নতুন করে মানুষদেরকে সেবা দিতে হবে। সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কমিউনিটি পুলিশিং করতে হবে।’
পুলিশ সংস্কার কমিশনকে ব্যর্থ বলে মনে করেন সাবেক আইজিপি
সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা পুলিশ সংস্কার কমিশনকে ব্যর্থ উল্লেখ করে বলেন, ‘সংস্কার কমিশন পুলিশের বিষয়ে বলছে অনেক বিষয় পরীক্ষা নিরীক্ষা দরকার। পরীক্ষা-নিরীক্ষা যদি দরকার এই কথা বলা হয় তাহলে এই সংস্কার কমিশনের কি দরকার। এই পুলিশ কমিশন ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন নিয়ে কিছু বলে না কিন্তু গন্ডগোল ওইখানেও আছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা যদি না থাকে তাহলে পুলিশ কিভাবে কাজ করবে। যাদের সুবাদে আমরা আজকে কথা বলতে পারছি সেটা কতদিন বলতে পারব সেটার কোনো গ্যারান্টি নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর যদি সদিচ্ছা না থাকে তাহলে সম্ভব না। এই সমাজে বিষাক্ত একটা বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। এটা আমাদেরকে বুঝতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক কিন্তু ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। এটা বদলানো পুলিশের হাতে নাই। পুলিশের অনেক অফিসাররা দুর্নীতিতে জড়িয়েছে। আমাকে একজন আইজিপি বলেছিলেন ঘুষ খাওয়ার থেকে শ্বশুরবাড়ি থাকা ভালো।’
আমরা জনতার মুখোমুখি থাকবো না, পাশাপাশি থাকবো
সমাপনী বক্তব্য রাখেন নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা সংক্রান্ত উপ-কমিটির সভাপতি ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত আইজি গোলাম রসুল। তিনি বলেন, ‘আমরা জনতার মুখোমুখি থাকবো না, পাশাপাশি থাকবো। আমরা সাধারণ মানুষের কাছে যেতে চাই; জনগণের পুলিশ, সাধারণ মানুষের পুলিশ হতে চাই।’
স্পেশাল ব্রাঞ্চের এই অতিরিক্ত আইজি আরও বলেন, ‘আজ থেকে ৬ থেকে ৭ মাস আগে বাংলাদেশ পুলিশকে একটি কিলারস ফোর্স হিসেবে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছিল। আমাদের বিশেষ সহকারী স্যার এই শব্দটি আমাকে বলেছেন। আল্লাহর অশেষ কৃপায় সবার সমর্থন ও মাঠ পর্যায়ের সহকর্মীদের ঐকান্তিক প্রয়াসে উই টার্নড দি ফোর্স লাইক দিস। আজ আমরা সামনা সামনি বসতে পেরেছি। মুখোমুখি জায়গার থেকে আজকের সমাবেশের উদ্দেশ্যে ছিল আমরা পাশাপাশি থাকবো। আমরা যে জনতার কাতারের পুলিশ এই বার্তাটি দেওয়ার জন্য এই আয়োজন। আমরা সকল শ্রেণি-পেশাকে ধারন করার চেষ্টা করেছিলাম। সারা দেশে এই বার্তা পৌঁছে দিতে চাই, জুলাই-আগস্টের যে পুলিশ ছিল সেই পুলিশ থেকে আমরা নিজেরা পরিবর্তিত হয়েছি। আজ আমরা এমন একটি পুলিশ হয়েছি যে পুলিশ নিয়ে আমরা সাধারণ মানুষের কাছে যেতে চাই। আমরা এদেশের সাধারণ জনগণের জন্য। বাংলাদেশ পুলিশের নবযাত্রাকে নতুনভাবে সামনের দিকে উদযাপন করতে চাই।’
কালের আলো/এমএএএমকে