পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে টাস্কফোর্সের জোরালো উদ্যোগ
প্রকাশিতঃ 10:14 am | November 15, 2024

মো.শামসুল আলম খান, কালের আলো:
বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য প্রায় দেড় মাস আগে আন্তসংস্থা টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এই টাস্কফোর্সকে নতুন করে সাজানোর পাশাপাশি প্রথমবারের মতো টাস্কফোর্সের সভাপতি করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে। এরপর থেকেই পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফায় বৈঠকে বসতে যাচ্ছে তাঁরা। ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে চিঠি দিয়ে প্রতিনিধি পাঠাতে বলা হয়েছে। বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ ফেরাতে সরকারও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের পরিচালক মুহাম্মদ আনিছুর রহমানের সই করা চিঠিতে বলা হয়, বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে গঠিত আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় সভায় অংশ গ্রহণ এবং প্রথম সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন বৃহস্পতিবারের (১৪ নভেম্বর) পাঠাতে বলা হয়েছে।
বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স গত ২৯ সেপ্টেম্বর পুনর্গঠন করে বর্তমান সরকার। পুনর্গঠিত টাস্কফোর্সে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, আইন ও বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে একজন করে উপযুক্ত প্রতিনিধি থাকবেন।
জানা যায়, এবার বাড়ানো হয়েছে টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি। এত দিন কার্যপরিধিতে তিনটি বিষয় থাকলেও এবার করা হয়েছে ছয়টি। এগুলো হলো বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ চিহ্নিত করা; পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে হওয়া মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করা ও তা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া; বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া; জব্দ বা উদ্ধার সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য উদ্যোগ নেওয়া; এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশ, বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য আহরণ করা এবং পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ সমন্বয় সাধন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরী টাস্কফোর্সের কাজ সমন্বয় করবেন। আর টাস্কফোর্সকে সাচিবিক সহায়তা দেবে বিএফআইইউ।
আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা মো. আবদুস সোবহান ওরফে গোলাপ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, এস আলম গ্রুপের মোহাম্মদ সাইফুল আলমসহ আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা, পুলিশ ও ব্যবসায়ীসহ অন্তত ২০০ জন অর্থপাচারকারী যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদপাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেসব অভিযোগ এরইমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান ও তদন্ত শুরু করেছে।
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ-সম্পদ পুনরুদ্ধারে অনুসন্ধান ও তদন্তে সরকার গঠিত আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের সহায়তা ছাড়াও দেশি-বিদেশি সহায়তা নিচ্ছে দুদক। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) সঙ্গেও একাধিক বৈঠক করে তারা। দুদকের গোয়েন্দা শাখা, মানি লন্ডারিং ও লিগ্যাল শাখার মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব বৈঠকে নেতৃত্ব দেন।
বর্তমানে পুনর্গঠিত আন্তঃসংস্থার কাজ হচ্ছে— বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ চিহ্নিত করে ফেরত আনার ব্যবস্থা নেওয়া, পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে দায়ের হওয়া মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা, কোনও বাধা থাকলে সেটা দূর করার উদ্যোগ নেওয়া, সংশ্লিষ্ট দেশ ও বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ও তথ্য সংগ্রহ করা এবং পাচার করা সম্পদ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো এবং অভ্যন্তরীণ সমন্বয় সাধন।
সূত্র জানায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালে প্রথম ১০ সদস্যের আন্তসংস্থা টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। পরে ২০২২ সালের ৫ জুন এর সদস্যসংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ১৪। বরাবরই আহ্বায়ক করা হয় অ্যাটর্নি জেনারেলকে। আর সদস্যসচিব ছিলেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের উপপ্রধান কর্মকর্তা। এত বছর তাঁরা শুধু বৈঠক করেছেন, কিন্তু দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেননি। ২০২৩ সালের ১৫ জানুয়ারি আবার পুনর্গঠন করা হয় এ টাস্কফোর্স।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৭ শতাংশ কর দিয়ে বাংলাদেশের বাইরে যেকোনোরূপে গচ্ছিত অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বৈধভাবে দেশে এনে আয়কর রিটার্নে দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তবে এ সুযোগ কোনো কাজে লাগেনি, এক টাকাও ফেরত আসেনি। বিএফআইইউ গত বছর অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে ৪৯ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দাখিল করে আদালতে। ওই প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, হংকং, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, কুয়েত, বেলজিয়াম, তানজানিয়ায় বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের কথা রয়েছে।
কালের আলো/এমএএইচ/ইউকেএম