লেট’স টকে জীবনের কথা শোনালেন প্রধানমন্ত্রী
প্রকাশিতঃ 10:26 pm | December 13, 2018

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
এই প্রথমবার কোন প্রধানমন্ত্রী মুখোমুখি হয়েছিলেন তরুণদের। ‘লেট’স টক উইথ শেখ হাসিনা’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তরুণদের সাথে সরাসরি কথা বলেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সারাদেশ থেকে শিক্ষার্থী, উদ্যোক্তা, তরুণ পেশাজীবী, অ্যাথলেটস, খেলোয়াড়, সংস্কৃতিকর্মীসহ দেড়শোর মতো তরুণ অংশ নেন।
অনুষ্ঠানে তরুণদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শোনেন তরুণদের স্বপ্নের কথাও। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার হিসেব না করে দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে, দেশের জন্য কাজ করতে তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দেশকে ভালোবাসতে হবে, মানুষকে ভালোবাসতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে কী পেলাম না পেলাম… দেশের জন্য কতটুকু দিতে পারলাম, মানুষের জন্য কতটা দিতে পারলাম তা ভাবতে হবে।”
তিনি বলেন, ‘পরশ্রীকাতরতা থেকে বের হয়ে এসে নিজেকে বলতে হবে, আমি পারি। আমি আমার মতো করেই ভালো করবো। কেউ দ্রুত উপরে উঠে গেলো দেখে আমাকে একটা অশুভ প্রতিযোগিতা করতে হবে, সেটা ঠিক নয়।”
“সেই সাথে দেশপ্রেম এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হই তাহলে একটি মানুষও অবহেলিত থাকবে না।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সরকার হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। আর তোমাদের দায়িত্ব নিজের মাঝে সেই ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি করে দেশের প্রতি দায়িত্ব, নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব এবং প্রতিবেশী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা।”
“আর সবসময় একটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে চললে দেশকে কিছু দিতে পারবে, নিজেও জীবনে কিছু করতে পারবে। হতাশ হওয়ার সুযোগ নেই। জীবনে অনেক ঝড়ঝাপ্টা আসবে। কিন্তু ইচ্ছাশক্তি প্রবল থাকলে যেকোনো বাধা অতিক্রম করা যায়।”
শেখ হাসিনা বলেন, “একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে যদি কেউ এগিয়ে যায়। তাহলে কোনো বাধাই বাধা বলে মনে হবে না। দেশকে এতদূর নিয়ে আসতে পেরেছি, তার প্রধান কারণ এই ইচ্ছাশক্তি। জাতির জনক বলে গেছেন, মহৎ অর্জনের জন্য মহান ত্যাগের প্রয়োজন। ত্যাগের মধ্যে দিয়েই অর্জন করা যায়। আর সৎ থাকতে হবে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যদি সৎ না থাকতাম, তাহলে ওয়ার্ল্ড ব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করতে পারতাম না। পদ্মাসেতুর কাজও শুরু করতে পারতাম না। আমার এই একটি সিদ্ধান্ত বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের আত্মমর্যাদাকে অন্য এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আর আমি মনে করি বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে আমাদের তরুণ প্রজন্মই পারবে। আজকে যারা তরুণ শুধু তারা নয়, বরং ভবিষ্যতেও, যেমন আজকেও যে শিশুটি জন্মাবে সেও তো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে। তবে তাদের জন্য একটি সুন্দর সমাজ গড়ে রেখে যেতে চাই।”
কবে দুর্নীতি মুক্ত হবে বাংলাদেশ? তরুণদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “এটা আমার লক্ষ্য আছে। আমি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আভিযান চালিয়েছি। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এরপর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করা হবে।”
তিনি বলেন, “আমরা সরকারি কর্মকর্তাদের আয় উপার্জনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সেখানে দুর্নীতি করার দরকার কী? অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসতে পারলে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব।”
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আপনি কাজ করে গেছেন। এটি নিয়ে আপনার মধ্যে কোন শঙ্কা কাজ করেছে বা করছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি চেয়েছি দেশের মানুষ শান্তিতে থাকুক। …আমি বুঝেছিলাম, জঙ্গিবাদ থাকলে কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। বিরোধী দলে থাকি, আর সরকারি দলে; যেটা নীতির ব্যাপার সেটার বিষয়ে সোচ্চার হওয়া। শুধু সরকারি দলে আসলেই করব, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় করব না এমন নয়। আমার দেশকে আমি ভালোবাসি। আর সে কারণেই এ বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে সবসময় প্রতিবাদ করেছি।”
তিনি বলেন, “আর আমাকে তো অনেকবার হত্যার চেষ্টা হয়েছে। কয়েকবার না অনেকবার। এমনকি সামনে থেকে গুলি করেও হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে আমাকে। যখন বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়েছি তখনও বাধা পেয়েছি। কিন্তু একটা বিষয়, এ দেশের মানুষ, যেখানে গিয়েছি সেখানে এত ভালোবাসা পেয়েছি। এই ভালোবাসা আমার শক্তি। সেটাই আমার প্রেরণা।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিচারণ
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “একদিন স্কুলে স্ট্রাইক করাতে গিয়ে দেখি, খুব লম্বা-চওড়া এক পুলিশ অফিসার; সে আমাকে ধমক দিচ্ছে। আমরা গেটের বাহিরে দাঁড়িয়ে, যে কেউ যেতে পারবে না। তো খুব ধমক দিচ্ছে যে, তুমি জানো আমি কে? তোমাকে আমি জেলে নিতে পারি। আমি বললাম, জেলখানায় তো আমরা প্রতি ১৫ দিন পরপর যাই। আমাকে এই ভয় দেখিয়ে তো লাভ নাই। আমি তো জেলখানায় সবসময় যাই।”
‘বলল সে, হ্যাঁ! তোমার নাম কী? আমি বললাম, “আমার নাম, বাবার নাম, হেড স্যার জানেন। তাকে জিজ্ঞাসা করে নিয়েন।”
শেখ হাসিনা বলেন, “এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু মেয়েরা ছিলো, তারা ইশারা দিয়ে আমাকে চলে আসতে বললো সেখান থেকে। ব্যস ওখান থেকে চলে আসলাম। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের বেড়া ফাঁক করে ওখান থেকে ঢুকে যেতাম। তখন বাস ছিলো মুড়ির টিনের মতো। তা সেরকম একটা গাড়িতে পুলিশ আমাদের ধাওয়া করছে। ওখান থেকে বের হয়ে পলাশি মোড় হয়ে, এখন যেটা জহরুল হক হলের ভিতর দিয়ে—ওয়াল টপকে ওখান থেকে আমরা রোকেয়া হলে ঢুকে গেলাম।”
ঘণ্টি বাজিয়ে স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছিলাম
কৈশরের একটি মজার ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, “ছোটবেলার একটা মজার ঘটনা বলি, ধর্মঘট চলছে তখন। আমরা ঠিক করলাম, স্কুল ছুটি দিতে হবে। তা এমনিতে তো আর দিবে না। হেড স্যারের রুমের পাশেই স্কুলের ঘণ্টিটা। এখন ঘণ্টিটা আমরা কিভাবে বাজাবো!”
“আমরা একটা মেয়েকে দায়িত্ব দিলাম ঘণ্টিটা বাজাবে, আরো কয়েকজনকে দায়িত্ব দিলাম দাড়োয়ান কিছু বোঝার আগেই গেটটা খুলে দেবে। যখন ঘণ্টি বাজাতে শুরু করলাম ছোট বাচ্চারা তারা সব ছুটে পালাতে শুরু করলো। তখন মজার বিষয় হলো বাচ্চারা ছুটছে তাদের ধরার জন্য শিক্ষকেরাও ছুটছে। আর তখন আমরা বের হয়ে চলে এলাম। স্কুল থেকে সবাই দৌড় দিয়ে এক দৌড়ে চলে গেলাম সব। মিটিংয়ে গেলাম। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি।”
প্রধান শিক্ষক সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের হেডমাস্টার আবার ভীষণ কড়া ছিলেন। কাজী ওমর আলী সাহেব, আমি উনাকে দেখলে ভয়ে দৌড়ে পালাতাম। কিন্তু খুব আদরও করতেন, খুব ভালো শিক্ষক ছিলেন। মানে গাধা পিটিয়ে মানুষ করা বলে না, উনিও তেমন আমাদের গাধা পিটিয়ে মানুষ করতেন।”
মায়ের কাছে দাবি আদায়ে হাঙ্গার স্ট্রাইক
মায়ের কাছে আবদার মেটানোর স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, “একদিন মা হঠাৎ করে বললেন মিটিংয়ে যেতে পারবে না। আর মা যদি একটা কথা বলতেন তা অমান্য করে কিছু করা আমাদের সাধ্যে ছিলো না। মা দরজাও লাগাতেন না, গেটও লাগাতেন না। কিছু করতেন না। শুধু বলতেন যেতে পারবে না। আর আমাদের সেই শিক্ষা ছিলো, মা বললে শুনতে হবে।”
“কিন্তু প্রতিবাদও তো করতে হবে। সুতরাং হাঙ্গার স্ট্রাইক। নাস্তা খাবো না, ভাত খাবো না, কিচ্ছু খাবো না। বসে বসে ভ্যা ভ্যা করে কান্না!”
বঙ্গবন্ধুকন্যা আরো বলেন, “আমার দাদা থাকলে খুব ভালো হতো। তিনি থাকা অবস্থায় এমন হলো, খুব জরুরি মিটিং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে যেতেই হবে। মা বললেন, ‘না আজকে বের হতে পারবে না।’ দাদা শুধু ডেকে মাকে বললেন, ‘দেখ, আমি তো কোনদিন আমার ছেলেকে মানা করিনি। আমি তো কোনদিন নিষেধ করিনি, তুমি নিষেধ করছো কেনো? ও যেতে চায়, যেতে দাও।’ আমার মা আবার মুরুব্বিদের কথা খুব মেনে চলতেন। দাদা বলেছেন। মা আর কিছু বললেন না। যাও, দাদাকে পেয়েছো এখন যাও।”
বাড়ির বড় মেয়ে ছিলাম, আলসেও ছিলাম খুব
’৭৫ পরবর্তী সংকটময় সময়ের তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “৭৫ পরবর্তী ৩-৪ বছর একটা অন্ধকার সময় ছিলো। বলা যায় একটা বাসায় বন্দি। সব জায়গায় যাবার সুযোগ ছিলো না। এমনকি নিজের পরিচয় দেবারও সুযোগ ছিলো না। একটা নামও দেওয়া ছিলো। ওই নামে আমাদের পরিচয়। নিজের পরিচয়টাও ছিলো না। তখন মনে হতো, জীবনের সবথেকে কম যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু নিয়েই চলব। সেখানে থেকে সংসারের প্রতিটি কাজ একে একে আমাদের শিখতে হলো, করতে হলো। করে করে শিখলাম।”
বাবা-মায়ের সংসারের আদুরের জীবনের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আসলে বাড়ির বড় মেয়ে ছিলাম। আলসেও ছিলাম খুব। এমনও অনেক দিন গেছে, না খেয়ে ঘুমিয়ে যেতাম। আব্বা এসে ঘুম ভাঙিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে দিতেন।”
“আমার খুব বদঅভ্যাস ছিলো বসে গল্পের বই পড়া আর গান শোনার। তখন মা এক কাপ চা বানিয়ে এনে দিতেন। নিজে খুব একটা বেশি কাজ করতাম না, আলসে ছিলাম এটা ঠিক। আর সেখান থেকে এমন একটা অবস্থায় পড়ে গেলাম, যে ঘর ঝাড়ু দেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু নিজেদের করতে হতো, করতাম।”
তরুণদের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর ১৯৭১ সালের গৃহবন্দি জীবন, ১৯৮১ সালের পর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ ও পরবর্তী সংগ্রামের জীবনের কথা উঠে আসে।
কালের আলো/এএ/এমএইচএ