দ্বন্দ্বে ভাঙন আরাকান আর্মিতে, দলত্যাগ করে পালিয়েছে ৩০০ সদস্য

প্রকাশিতঃ 11:06 pm | August 13, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

মিয়ানমারের জান্তা শাসকদের অন্যতম শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় দেশটিতে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির জনপ্রিয়তা বেড়েছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানেই আরাকান আর্মির (এএ) ভেতরে মাদক ব্যবসা ও লুটপাটের সম্পদ ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব ব্যাপক আকার নিয়েছে। যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নিজেদের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে উত্তর মংডু এলাকায় টহল ও গেট নিয়ন্ত্রণ কড়াকড়ি করলেও এএ এর ভেতর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষের ক্লান্তি। ভাঙতে শুরু করেছে মনোবল। মংডুর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের জলসীমায় জান্তারা নৌশক্তি বাড়ানোর ফলে আর পেরে উঠছে না এএ। দলত্যাগ করছেন বহু সদস্য।

মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) সকালে কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালী সীমান্তে একটি একে-৪৭ রাইফেল, দুটি ম্যাগাজিন ও ৫২ রাউন্ড গুলি নিয়ে বিজিবির কাছে আত্মসমর্পণ করা আরাকান আর্মির সদস্য জীবন তঞ্চঙ্গ্যা (২১) দাবি করেছেন, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে আরাকান আর্মিতে ভাঙন শুরু হয়েছে। মংডুর একটি ক্যাম্প থেকে আরাকান আর্মির (এএ) অন্তত ৩০০ সদস্য পালিয়েছে। যাদের মধ্যে কেউ কেউ যেকোনো সময় বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করতে পারে। এটি সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

জানা যায়, এর আগের রাতেই ঘুমধুম সীমান্তে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাত ১০টার পর থেকে থেমে থেমে তীব্র গুলির শব্দ শোনা যায়, যা স্থানীয়দের ধারণা অনুযায়ী, মিয়ানমারের তুমব্রু এলাকার নারিকেল বাগিচা সংলগ্ন স্থানে এএ ও আরসা বা আরএসও-র মধ্যে বড় ধরনের সংঘর্ষ ছিল। সংঘর্ষের স্থান সীমান্ত পিলার থেকে ৩০০ থেকে ৩৩০ মিটার মিয়ানমারের ভেতরে অবস্থিত। সীমান্তে এমন পরিস্থিতি যে কোনো সময় গুলির আওতা বা অনুপ্রবেশের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, ফলে বিজিবির টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি আরও জোরদার করা হয়েছে।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বেগতিক পরিস্থিতিতে নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে আরাকান আর্মি জনবল সঙ্কট দূর করতে আশপাশের টাউনশিপ থেকে নতুন যোদ্ধা সংগ্রহ করছে। তবে তাদের বড় অংশই রাখাইন জনগোষ্ঠীর নয়; বরং রাখাইন রাজ্যের অন্য ছয়টি জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ভাষাগত পার্থক্য, স্থানীয় ভূগোল সম্পর্কে অজ্ঞতা ও যুদ্ধক্ষেত্রে অনীহা এই নতুন বাহিনীর কার্যক্ষমতাকে দুর্বল করেছে, তৈরি করেছে সমন্বয় সংকট। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জনবল সংকট, অভ্যন্তরীণ বিভেদ, ভাষাগত অমিল এবং বহুমুখী চাপ মিলিয়ে উত্তর মংডুতে দ্রুত প্রভাব হারাচ্ছে আরাকান আর্মি। ফলে সীমান্তের দুই পাশেই অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতি মানবিক দিকও উদ্বেগজনক। বুথিডং এলাকায় খাদ্য সংকট চরমে পৌঁছেছে। এতে করে বহু রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। এমন প্রেক্ষাপটে সীমান্তের অপর প্রান্তে যে কোনো আকস্মিক অনুপ্রবেশ বা সংঘাতের জন্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) উচ্চমাত্রার সতর্কতা বজায় রাখতে হচ্ছে।

  • মাদক ব্যবসা ও লুটপাটের সম্পদ ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব ব্যাপক আকার নিয়েছে
  • এএ এর ভেতর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষের ক্লান্তি
  • মংডুর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের জলসীমায় নৌশক্তি বাড়িয়েছে জান্তারা
  • আরও জোরদার করা হয়েছে বিজিবির টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি
  • দু’দফায় বিজিবির তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে ফিরেছে তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের ১৫ পরিবার

স্থানীয় এবং বিভিন্ন গোপন সূত্র জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যের উত্তরের সাম্প্রতিক অস্থিরতা ক্রমেই বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। মংডু সীমান্তে আরাকান আর্মির (এএ) জনবল সংকট, অভ্যন্তরীণ বিভেদ এবং নিরাপত্তা শঙ্কা শুধু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সামরিক ভারসাম্যকে বদলে দিচ্ছে না বরং সরাসরি প্রভাব ফেলছে কক্সবাজার ও বান্দরবানের সীমান্ত ব্যবস্থাপনায়। একই সূত্র মতে, উখিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ি ও মংডুর বিপরীতে অন্তত ১৩টি পয়েন্টে আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) এবং এএ-র গতিবিধি বেড়েছে। টাউংপিও লেৎ-ইয়ার, এনগারাঘ্যুং, বাউতলা-সরিশিং পাড়া, বাউদুল্লা-মাহিতাউং, অকচিলপাড়া, রেজুপাড়া-চৌধুরীপাড়া এবং লেম্বুচড়া-ল্যাংমুইপাড়া বেল্টগুলো এখন নতুন করে নিরাপত্তা নজরদারির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। সীমান্তে এমন পরিস্থিতি যে কোনো সময় গুলির আওতা বা অনুপ্রবেশের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে, ফলে বিজিবির টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি আরও জোরদার করা হয়েছে।

এর মাঝেই গত জুলাই মাসে একটি বিরল মানবিক ঘটনাও ঘটেছে। গত ২২ ও ২৩ জুলাই দুই দফায় তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের ১৫টি পরিবার, মোট ৭১ জন, ৩৪ বিজিবির তত্ত্বাবধানে ঘুমধুম সীমান্তের পিলার ৩৭-এর ‘আমবাগান’ পয়েন্ট দিয়ে স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যায়। সংঘাতের কারণে গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই পরিবারগুলো ঘুমধুমের বাইশফাঁড়ী তঞ্চঙ্গ্যা পাড়ায় আশ্রয়ে ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে নিজ এলাকায় পরিস্থিতি শান্ত হলে তারা দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়। বিজিবি জানিয়েছে, পুরো প্রক্রিয়াটি শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনকভাবে সম্পন্ন হয়েছে, বলপ্রয়োগের কোনো প্রশ্ন ওঠেনি।

পরিবর্তিত নতুন বাস্তবতায় রাখাইনের উত্তরাংশে যে শক্তির পুনর্বিন্যাস চলছে, তার প্রতিটি দিক বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলছেন, একদিকে আরাকান আর্মির ভেতরের ভাঙন ও রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নতুন সমন্বয়, অন্যদিকে খাদ্য সংকট ও জনবসতির বাস্তুচ্যুতি-সবই সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় চাপ তৈরি করছে। বাংলাদেশের জন্য এই পরিস্থিতি শুধু প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ নয়, বরং মানবিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও বড় পরীক্ষা। সীমান্তে অনুপ্রবেশ, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান, সশস্ত্র সংঘর্ষ-সবকিছুর জন্য প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। একই সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে এই সংকট মোকাবিলায় কার্যকর সমন্বয়ে গুরুত্বারোপ করে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এটি করা সম্ভব হলে সীমান্ত নিরাপত্তা ও মানবিকতা-দুটোই সমানভাবে সুরক্ষিত হবে।

কালের আলো/এমএসএএকে/এসআইপি