গৌরবময় সাঁজোয়া কোরের কর্নেল কমান্ড্যান্ট সেনাপ্রধান, কল্যাণকর পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার

প্রকাশিতঃ 8:12 pm | September 22, 2021

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

‘প্রাণ দেব মান নয়’ মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া কোর। প্রায় ৫০ বছর আগে গৌরবময় এক পথচলা শুরু হয় কোরটির। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামেও রয়েছে তাদের গৌরবোজ্জ্বল এক ইতিহাস। সুদীর্ঘ যাত্রাপথে তাঁরা পেয়েছে সাতজন কর্নেল কমান্ড্যান্ট। বর্ণাঢ্য সামরিক ঐতিহ্য ও রীতিতেই এবার তাঁরা পেয়েছেন অষ্টম কর্নেল কমান্ড্যান্ট।

গভীর দেশপ্রেম আর সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের স্বাক্ষর রাখা এই কোরের নতুন কর্নেল কমান্ড্যান্ট হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) বগুড়ায় অবস্থিত মাঝিরা সেনানিবাসে আর্মার্ড কোর সেন্টার অ্যান্ড স্কুলের শহীদ লে. বদিউজ্জামান প্যারেড গ্রাউন্ডে অভিষেক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি এই দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

সাঁজোয়া কোরের ইতিহাসের সঙ্গে নিজেকে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করার সুযোগ পেয়ে আনন্দিত এবং গর্বিত জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ। এই দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাওয়ায় তিনি মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছেন।

নিজেকে বিশেষ ভাগ্যবান মনে করে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনকালে কোরের জন্য কল্যাণকর যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণে সচেষ্ট থাকার দৃঢ় অঙ্গীকার করেছেন। পাশাপাশি কোরের অগ্রযাত্রাকে বেগবান ও আধুনিকায়নেও সবার সহযোগিতা চেয়েছেন নতুন এই কর্নেল কমান্ড্যান্ট।

সেনাপ্রধান সাঁজোয়া কোরের ‘কর্নেল কমান্ড্যান্ট’ হিসেবে দায়িত্বভার নেওয়ায় নব উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে কোরটির সদস্যদের মাঝেও। অতীতের ধারাবাহিকতায় সামনের দিনগুলোতেও দেশসেবার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রতিটি সদস্য।

বঙ্গবন্ধুর নি:স্বার্থ সংগ্রামেই সার্বভৌম দেশ
সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ নিজের বক্তব্যের শুরুতেই গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন বাঙালি জাতির চির আরাধ্য পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি বলেন, ‘মহান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, বহু যুগের নিঃস্বার্থ সংগ্রাম এবং অসামান্য আত্মত্যাগ বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ।’

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদদের অপরিমেয় শ্রদ্ধা-বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করে জেনারেল শফিউদ্দিন বলেন, ‘১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আহবানে সাড়া দিয়ে সাঁজোয়া কোরের অকুতোভয় সদস্যরা দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে সাঁজোয়া কোরের ৩৯০ জন সদস্য অংশগ্রহণ করে ৫৯ জন বীর সেনানী শহীদ হন এবং ০৪ জন সদস্য অনন্য দেশপ্রেম, কর্তব্যবোধ ও বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য খেতাবপাপ্ত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধে এই কোরের সদস্যগণ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে সে গৌরবজ্জল ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তা আগামী দিনে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।’

তিনি বলেন, ‘মাতৃভূমিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করার প্রয়াসে মহান মুক্তিযুদ্ধে এই কোরের সদস্যরা যে সাহস, উদ্দীপনা ও অপ্রতিরোধ্য লড়াই করেছিলেন জাতি তা গভীর শ্রদ্ধার সাথে চিরদিন স্মরণ করবে।’

পূর্বসূরীদের স্মরণ; ইতিহাসের বর্ণচ্ছটায় সাঁজোয়া কোর
জেনারেল শফিউদ্দিন বলেন, ‘অভিষেক প্যারেডের মাধ্যমে আমাকে কর্নেল কমান্ড্যান্ট হিসেবে বরণ দিবসের এই তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্তে আমি স্মরণ করছি সাঁজোয়া কোরের ভূতপূর্ব সকল কর্নেল কমান্ড্যান্ট ও সেন্টার কমান্ড্যান্টসহ সকল প্রাক্তন সদস্যদের, যাদের দুরদর্শিতা, নিরলস পরিশ্রম ও অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এই কোর আজ সুদৃঢ় ভিত্তির উপর অধিষ্ঠিত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সাঁজোয়া কোর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি সামরিক ঐতিহ্য ও ইতিহাসসমৃদ্ধ জ্যেষ্ঠতম কোর। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তথা ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ঢাকা সেনানিবাস্থ বালুঘাটে, ১ম বেংগল ল্যান্সার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সাঁজোয়া কোর তথা সমর সম্রাট এর যাত্রা শুরু হয়।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সাঁজোয়া কোর দেশপ্রেম ও পেশাদারিত্বের সর্বোচ্চ মান প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ১৯৮৯ সালের ৫ এপ্রিল মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আব্দুস সালাম সাঁজোয়া কোরের প্রথম কর্নেল কমান্ড্যান্ট হিসেবে অভিষিক্ত হন। সাঁজোয়া কোর ১৯৯৪ সালের ২৫ এপ্রিল জাতীয় পতাকা এবং একই বছরের ২৬ এপ্রিল রেজিমেন্টাল কালার প্রাপ্তির গৌরব অর্জন করে।’

সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত সম্পর্কের মাত্রা
অষ্টম কর্নেল কমান্ড্যান্ট হিসেবে অভিষিক্ত হয়ে জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি পদাতিক রেজিমেন্টের সদস্য হলেও পেশাগত জীবনের সুদীর্ঘ যাত্রাপথে এই কোরের সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। জিওসি, আর্টডক হিসেবে দায়িত্ব পালানকালে সেই সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হয়।

চলতি বছরের ২৪ জুন সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ পূর্বক আজ সাঁজোয়া কোরের ‘কর্নেল কমান্ড্যান্ট’ হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ায় এই সম্পর্কের মাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হলো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠতম ও ঐতিহ্যবাহী এই কোরের কর্নেল কমান্ড্যান্ট হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ায় আমি আবারো বলছি, আমি অত্যন্ত গর্বিত।

অনুষ্ঠানে আর্টডকের জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম মতিউর রহমান, সেনা সদরের অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

৪১ তম বাৎসরিক অধিনায়ক সম্মেলনে যোগদান
আইএসপিআর জানায়, এদিন প্যারেড স্কয়ারে পৌঁছালে সেনাবাহিনী প্রধানকে আনুষ্ঠানিক অভিবাদন জানানো হয় এবং সাঁজোয়া কোরের একটি চৌকষ দল তাকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করে। পরে সেনাবাহিনী প্রধান মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মদানকারী সাঁজোয়া কোরের বীর শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ ‘সাঁজোয়া চিরন্তন’ এ পুস্পস্তবক অর্পন করেন এবং আর্মার্ড কোর সেন্টার অ্যান্ড স্কুলের ঐতিহ্যবাহী সাঁজোয়া জাদুঘর পরিদর্শন করেন।

অনুষ্ঠান শেষে সেনাবাহিনী প্রধান সাঁজোয়া কোরের ৪১তম বাৎসরিক অধিনায়ক সম্মেলনে যোগ দেন। তিনি সম্মেলনে উপস্থিত সাঁজোয়া কোরের ইউনিটসমূহের অধিনায়ক এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন এবং সাঁজোয়া কোরের উন্নয়ন, পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও দেশে-বিদেশে পরিচালিত কার্যক্রম বিষয়ে মতবিনিময় করেন।

সেনাপ্রধান সাঁজোয়া কোরের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য এবং দেশমাতৃকার সেবায় এই কোরের অবদানের কথা স্মরণ করেন এবং আধুনিক ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সদা প্রস্তুত থাকতে সাঁজোয়া কোরের সকল সদস্যের প্রতি আহ্বান জানান।

কালের আলো/এসআরকে/এনএল

Print Friendly, PDF & Email