চিকিৎসক পরিচয়ে বিয়ে করে পাচার করতেন ইরাকে
প্রকাশিতঃ 9:52 pm | September 11, 2021

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলো:
লিটন মিয়া। এইচএসসি পাস করে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চাকরি নেন। অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে সেখান থেকে চাকরিচ্যুত হন। পরবর্তীতে চলে যান ইরাকে। দেশটির রাজধানীর একটি হাসপাতালে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেন পরিচয় দিয়ে দেশে বিয়ে করতেন। এভাবে ছয়জনকে বিয়ে করে পাঁচজনকে ইরাকে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নিজের বউ ছাড়াও অন্তত চল্লিশজন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শনিবার সকালে রাজধানীর উত্তরা ও মিরপুরে র্যাবের অভিযানে আটক হয়েছেন লিটন মিয়া ও তার সহযোগী আজাদ।
র্যাবের ভাষ্য, লিটন মিয়া নারী পাচারকারী সিন্ডিকেটের মূলহোতা। তারা দুজন সংঘবদ্ধ মানবপাচার চক্রের সদস্য। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় একটি বিলাসবহুল প্রাইভেট করা, বিয়ার, দেশি-বিদেশি জাল টাকা, পাসপোর্ট ও বিভিন্ন সিল।
শনিবার (১১ সেপ্টেম্বর) বিকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে ডা. লিটন
১৯৯২ সালে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এইচএসসি পাস করেন লিটন। তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন, এরপর অনৈতিক কাজের দায়ে তাকে ২০১০ সালে চাকরিচ্যুত করা হয়। ২০১৩ সালে ইরাকে গিয়ে সবার কাছে নিজেকে ডা. লিটন বলে পরিচয় দিতে থাকেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বাগদাদের একটি হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন বলে প্রচার করতেন। আর নারীদের টার্গেট করে বাগদাদে চাকরির প্রলোভন দিয়ে নিয়ে যেতেন তিনি।
টার্গেট নার্সদের
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে নার্সদের ব্যপক চাহিদা রয়েছে। আর লিটন যেহেতু আগে মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন তার এই সেক্টরের বিষয়ে ধারনা ছিলো। এজন্য পাচারের জন্য তিনি নার্সদের টার্গেট করতেন। যেসব নার্সদের বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা থাকতো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সখ্যতা গড়ে তুলতেন। ইরাকের স্বনামধন্য হাসপাতালেমোটা বেতনে চাকরির প্রলোভন, আবার কখনো নিজে বিয়ে করবেন বলে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হতো। এরপর সেখানে আটকে রেখে সুবিধামতো সময়ে বিভিন্ন ক্লায়েন্টের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হতো। এর বাইরে অন্যান্য নারীদের বিভিন্ন সুপারশপ, বিউটি পার্লারে চাকরির কথা বলেও পাচার করা হতো।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অন্তত ৬টি বিয়ে করা লিটন নিজেকে অবিবাহিত বলে পরিচয় দিতেন। বেশিরভাগ বিয়েগুলোই করেছেন টেলিফোনে। নারীদেরকে বিয়ে করার প্রলোভন দেখিয়ে ইরাকে নিয়ে যেতেন। যে ৬ জনকে বিয়ে করেছেন এর মধ্যে ৫ জনকেই পাচার করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এই মানবপাচার চক্রের মূলহোতা লিটন। এছাড়া দেশে এইনচক্রে ১০-১৫ জন এবং ইরাকে আরো ৫-৭ জন রয়েছে বলে জানা গেছে। ইরাকে তাদেন ৬-৭টি সেফহাউজ রয়েছে, যেখানে পাচারকৃতদের নিয়ে আটকে রাখা হতো।

ভুক্তভোগী দুইজনের বরাত দিয়ে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, দুইজনের মধ্যে একজনকে বিয়ে করে আরেকজনকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ২০১৯ সালে ইরাকে নিয়ে যায় লিটন। এর মধ্যে একজন গিয়ে একটি সেফ হাউজে ৪০-৫০ জনকে দেখেছেন। যেখানে ১৫-২০ জন নারী রয়েছেন। একজন কৌশলে পালিয়ে গিয়ে একটি হাসপাতালে তিনমাস চাকরি করেন। এরপর দেশে ফিরে আসেন তিনি। আরেকজনকে মোট তিনবার বিভিন্ন দালালের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। সর্বশেষ যার কাছে বিক্রি করা হযেছিলো তার সহায়তায় তিনি প্রায় দুই বছর পর দেশে ফিরেন। মানবপাচারের দায়ে লিটন দুইবার ইরাকে গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছেন। এরপর পালিয়ে ২০১৯ সালেই দেশে ফিরে আর যাননি। দেশে এসে তিনি বালুর ব্যবসাসহ অন্যান্য কাজ করছিলেন। দেশে তার নামে ৬-৭টি মামলা থাকলেও এই প্রথমবার তিনি আটক হলেন।
ট্রাভেল এজেন্সির লাইসেন্স নিয়ে মানবপাচারে আজাদ
আজাদ ১৯৯৩ সাল থেকে বিদেশে মানবসম্পদ রপ্তানির কাজ করছেন। তিনি এখন পর্যন্ত ২৫-৩০ হাজার লোক বিদেশে পাঠিয়েছেন বলে জানা গেছে। লিটনের সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে ২০১৬ সাল থেকে তিনি চাকরির প্রলোভনে অন্তত ২০০-২৫০ জনকে পাচার করে দেন।
পাচারকৃতদের কাউকেই সে চাকরি দিতে পারেনি। উল্টো সেখানে নিয়ে জিম্মি করে অর্থ আদায় করা হতো। দেশ থেকে ভুক্তভোগীদের স্বজনরা সেসব অর্থ আজাদের কাছে দিতেন। এছাড়া মানবপাচার প্রক্রিয়ার জন্য ভুয়া চাকরির বিজ্ঞাপন, ভিসার ব্যবস্থা, টিকিট কাটাসহ সব ধরনের কাজ করতেন আজাদ।
যা বলছেন ভুক্তভোগীরা
কুয়েত থেকে তিন মাস পর পালিয়ে আসা এক ভুক্তভোগী তরুণী বলেন, একটি চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে আমি সিভি জমা দেই। তারপর ডাক্তার পরিচয় দিয়ে লিটন আমাকে ফোন করে যোগাযোগ করেন। একপর্যায়ে তিনি আমাকে বিয়ে করতে চান, বিয়ে করে কুয়েতে নিয়ে যাবে এবং সেখানে নিয়ে হাসপাতালে চাকরি দেবে বলে জানায়।
পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে আমাকে বিয়ে করে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কুয়েতে নিয়ে যান লিটন। আর আমার সব কাগজপত্র প্রসেসিং করেন আজাদ। কুয়েতে যাওয়ার পর দেখি তিনি ডাক্তার না। সে কি করছে দেখতে চাইলে আমাকে তার অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে ৫০-৬০ জনকে দেখি, এদের মধ্যে ১০-১৫ জন মেয়েও ছিলো। তখন লিটন বলে এদের সবাইকে আমি এনেছি, তাদেরকে কাজ দেবো এখানে।
বিষয়টি সন্দেহ হওয়ায় একদিন লিটন বাসা থেকে বের হওয়ার পর আমি পাসপোর্ট নিয়ে বের হয়ে যাই। বাগদাদের একটি হাসপাতালে তিনমাস চাকরি করে আমি দেশে ফিরে আসি। করোনার কারণে অনেকদিন কোন পদক্ষেপ না নিলেও একপর্যায়ে আমি র্যাবের কাছে অভিযোগ করি। আমার একটাই চাওয়া তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।
আরেক ভুক্তভোগী বলেন, আমি ঢাকায় একটি হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজ করছিলাম। একপর্যায়ে লিটনের মাধ্যমে যোগাযোগের পর চাকরির কথা বলে ২০১৮ সালের শেষের দিকে ১ লাখ ১৭ হাজার টাকার বিনিময়ে আমাকে কুয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়। ভালো সেলারি, কম কাজ এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ নানান সুবিধার কথা বলা হয়েছিলো। আমরা একসঙ্গে ৪-৫ জন মেয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে নিয়ে আমাকে একটি বাসায় রাখা হয় যেখানে আরো ৭-৮ জন মেয়ে ছিলো। এছাড়া আরো ৩০-৩৫ জনকে দেখেছি। একপর্যায়ে লিটনের কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়া সে আমাকে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেওয়ার হুমকি দেয়। পরে এক এক করে আমাকে চারজনের কাছে বিক্রি করে লিটন। সর্বশেষ যার কাছে বিক্রি করে সে তিন লাখ টাকা দিয়ে কিনেছিলো আমাকে। তার সহায়তায় আমি ওখানকার একটি হাসপাতালে চাকরি করে তার টাকা ফেরত দিয়ে দেশে ফিরে আসি।

কে এই লিটন মিয়া?
র্যাব বলছে, ১৯৯২ সালে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এইচএসসি পাস করেন লিটন মিয়া। এরপর সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে চাকরি শুরু করেন। মিথ্যা প্ররোচনা ও অনৈতিক কাজের জন্য সেখান থেকে তার চাকরি চলে যায়। এরপর লিটন ইরাকে যান। এসময় নিজেকে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের একটি স্বনামধন্য হাসপাতালে চাকরি করতেন বলে পরিচয় দিতেন। পরবর্তীতে কয়েকজন মিলে ইরাকে নারী পাচার সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন।
গ্রেপ্তার লিটন নারীদের প্রথমে ইরাকে মেডিকেল চাকরির প্রলোভন দেখাতেন। এভাবে সখ্যতা গড়ে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে পাঁচ-ছয়জনকে বিয়ে করেন। অনেককে টেলিফোনে কিংবা সরাসরিও দেশে এসে বিয়ে করেছেন। এরমধ্যে লিটন ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ইটালিতে ছিলেন। এই সময়েই তিনি বিয়েগুলো করেছেন। এসব বিয়ে লিটন পাচারের উদ্দেশে করেছেন বলে দাবি র্যাবের।
র্যাব জানায়, সবশেষ পাচার হওয়া এক নারী র্যাবকে জানিয়েছেন- তিনি ইরাকে সেফহাউজে থাকাকালে সেখানে ১৫-২০ জনকে দেখেছেন। সেফ হাউজ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর এই নারী ইরাকের একটি হাসপাতালে চাকরি করতেন। পরবর্তীতে সেখান থেকে পালিয়ে দেশে ফিরে আসেন। গ্রেপ্তার লিটন মিয়া ২০১৯ সালের পর আর ইরাকে যেতে পারেননি। পরে দেশেই বালি ব্যবসাসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন।
আজাদের যে ভূমিকা ছিল
র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার আজাদ দেশেই সিন্ডিকেটটির প্রতারণার বিষয়টি দেখতেন। দেশে তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই এসব নারী-পুরুষকে পাচার করা হয়েছে। তিনি পাসপোর্ট প্রস্তুত, টাকা নেওয়া, টিকিট কেটে দেওয়া এসব বিষয় দেখতেন।
কালের আলো/এসবি/এমএম