স্কুলশিক্ষক থেকে দুর্ধর্ষ জঙ্গি নেতা, ঘনিষ্ঠতা ছিল বাংলা ভাইদের সাথে

প্রকাশিতঃ 8:57 pm | September 09, 2021

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলো:

রাজধানীর বসিলায় জঙ্গি তৎপরতায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেপ্তার এমদাদুল হক ওরফে উজ্জল মাস্টার নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবির একটি অংশের প্রধান বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

তিনি একজন স্কুলশিক্ষক ছিলেন। ধর্মীয় বয়ান শুনে উদ্বুদ্ধ হন জঙ্গি তৎপরতায়। একপর্যায় জেএমবির প্রতিষ্ঠাতাদের সংস্পর্শে আসেন। তাদের ফাঁসিতে ঝোলানোর পর তিনি নিজেই একটি অংশের নেতা হয়ে যান।

বৃহস্পতিবার (০৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এমদাদুলের বিষয়ে তাদের কাছে থাকা তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক ও মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

এর আগে এদিন ভোরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলার সিটি ডেভোলপমেন্ট হাইজিংয়ের একটি আবাসিক ভবন থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে এলিট ফোর্স র‌্যাব। তার বাসা থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, পাঁচ রাউণ্ড গুলি, রাসায়নিক দ্রব্য, দেশীয় তৈরি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, উগ্রবাদী বই ও নগদ তিন লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ময়মনসিংহের একটি কলেজ থেকে বিএ পাস করে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন এমদাদুল হক ওরফে উজ্জল মাস্টার। জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় ওই স্কুল থেকে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরবর্তীতে ২০০২ সালে মুক্তাগাছায় একজন জঙ্গি নেতার বয়ান শুনে শায়েখ আব্দুর রহমানের কাছে বায়াত গ্রহণ করেন। এরপর জামালপুরে একটি আস্তানায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। জঙ্গিবাদে ব্যাপক তৎপরতা থাকায় দ্রুত তিনি ময়মনসিংহের অঞ্চলের দুর্ধর্ষ নেতা হয়ে ওঠেন।

র‌্যাব জানায়, গ্রেপ্তার এমদাদুল হক ওরফে উজ্জল মাস্টার শীর্ষ জঙ্গি নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই ও সালাহউদ্দিন সালেহীনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। তিনি জেএমবির শীর্ষ নেতাদের ময়মনসিংহে সফরকালীন সময়ে বিশেষ দায়িত্বে থাকতেন। বিশেষ করে নেতাদের গোপন আস্তানায় অবস্থান, মিটিং ও বয়ান আয়োজনে ভূমিকা রাখতেন।

গত ৪ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহে গ্রেপ্তার চার জঙ্গিসহ জেএমবির জুলহাসসহ ১০ সদস্য তার কাছ থেকে বায়াত গ্রহণ করেন।

এই দশজনই বিভিন্ন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন।

র‌্যাব আরও জানায়, জঙ্গি সদস্যদের কেউ কেউ এখনও আত্মগোপনে রয়েছেন। তাদের গ্রেপ্তারে তারা (র‌্যাব) অভিযান অব্যাহত রেখেছে।

র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বিভক্ত জেএমবির একটি গ্রুপের কর্ণধার জঙ্গি নেতা এমদাদুল হক ওরফে উজ্জল মাস্টার। শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায় কার্যকরের পর সংগঠনটি নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়ে। ফলে জেএমবি নিজেদের মধ্যে অন্তঃকোন্দলে জড়ায়। সংগঠনের ভেতর ও বাইরে দুটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়। জঙ্গি নেতা সারোয়ার জাহানের নেতৃত্বে জেএমবি সুসংহত হয় এবং গড়ে তোলা হয় জেএমবি ‘সারোয়ার-তামিম গ্রুপ’।

তিনি বলেন, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন জেএমবির আমির সারোয়ার জাহান এবং তামীম চৌধুরী। তারাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নাশকতার ছক তৈরি করেছিলেন। একই বছরের ৮ অক্টোবর র‌্যাবের

অভিযানে পালাতে গিয়ে বিল্ডিং থেকে পড়ে জেএমবির তৎকালীন আমির সারোয়ার জাহান মারা যান। হলি আর্টিজান ঘটনার পর এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫০০ জঙ্গি (বিভিন্ন সংগঠন এবং জেএমবির আট শতাধিক সদস্য) গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এতে জেএমবির সাংগঠনিক সক্ষমতা দুর্বল হয়ে গেছে।

র‌্যাব জানায়, জঙ্গিরা বিভিন্ন সময়ে লুট, ছিনতাই ও ডাকাতি মাধ্যমে অর্থ জোগাড় করছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ময়মনসিংহ, জামালপুর ও রাজশাহীতে অভিযান চালানো হয়। বর্তমানে গ্রুপে গ্রুপে বিচ্ছিন্ন পুরাতন জেএমবি সদস্যরা সংগঠন চাঙ্গা করার চেষ্টায় করছেন। মধ্যরাত থেকে আজ সকাল পর্যন্ত র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-২ এর অভিযানে বসিলা থেকে জেএমবির একটি গ্রুপের কর্ণধার মো. এমদাদুল হক ওরফে উজ্জল মাস্টারকে গ্রেপ্তার করা হয়।

অর্থ সংগ্রহে ডাকাতি
র‌্যাবের ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে অনুসারীদের নাশকতা, ডাকাতি, ছিনতাই এ অংশগ্রহণ করতে তার সদস্যদের নির্দেশ দিতেন এমদাদুল।

২০০৩ সালে মুক্তাগাছায় ব্র্যাক অফিসে ডাকাতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল তার। নাশকতা ও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ঢাকা-ময়মনসিংহের বিভিন্ন থানায় ২০০৭, ২০১২, ২০১৫ ও ২০২০ সালে মামলা হয়।

২০০৭ সালে মুক্তাগাছায় জঙ্গি নেতাদের সঙ্গে নাশকতার গোপন বৈঠক চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মধ্যেও পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এমদাদুল।

জঙ্গি ধরিয়ে দেয়ায় নিকটাত্মীয়কে হত্যা
২০০৭ সালে এমদাদুল হক তার নিকটাত্মীয় রফিক মাস্টারকে হত্যা করেন বলে তথ্য পেয়েছে র‌্যাব।

এই হত্যার কারণ হিসেবে বাহিনীটি জানায়, রফিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তাদের (জেএমবির) বেশ কয়েকজন জঙ্গি সদস্যকে ধরিয়ে দেন। পরে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে তাকে হত্যা করা হয়।

২০০৭ সালে এই ঘটনায় মামলার আসামি হলে পালিয়ে যান এমদাদুল। ২০০৮ থেকে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় নাম পরিবর্তন করে ছদ্মবেশে অবস্থান করেন। তিনি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী, খেলনা বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা, রিকশাচালক ও রাজমিস্ত্রির পরিচয়ে থাকেন।

একাধিকবার গ্রেপ্তার
২০১২ সালে রাজধানীর উত্তরা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার হন এমদাদুল হক। ‘গোপন বৈঠকে নাশকতার পরিকল্পনা’র মামলায় দুই বছর কারাগারেও ছিলেন। ২০১৫ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবারও বিস্ফোরকসহ গ্রেপ্তার হন। ২০১৬ সালে জামিন নিয়ে পুনরায় আত্মগোপনে চলে যান।

কালের আলো/ডিএসকে/এমএম