যাত্রীবেশে দূরপাল্লার বাসে উঠে নির্জন এলাকায় গিয়ে ডাকাতি করতো তারা
প্রকাশিতঃ 4:42 pm | September 05, 2021

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলো:
উত্তরবঙ্গের পলাশবাড়ী থেকে পীরগঞ্জ পর্যন্ত ৪৮ কিলোমিটার নির্জন মহাসড়ক ডাকাতির হটস্পট। গত ডিসেম্বর থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই এলাকায় একটি চক্র অন্তত ৮টি বাসে ডাকাতি করেছে। এরমধ্যে বাসচালককে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। চক্রটি পীরগঞ্জে ডাকাতি করে ফের ঢাকার আশুলিয়ায় ফিরে আসে।
র্যাব জানিয়েছে, রাতে রাজধানীর বিভিন্ন বাস কাউন্টার থেকে যাত্রীবেশে দূরপাল্লার বাসের টিকেট সংগ্রহ করতো। পরে সেই বাসে উঠে নির্জন এলাকায় পৌঁছে বাসচালককে ধারালো ছুড়ি দেখিয়ে বাসের নিয়ন্ত্রণ নিতো। এরপর বাসে থাকা যাত্রীদের কাছ থেকে লুটে নিতো মূল্যবান জিনিসপত্র।
সম্প্রতি ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া হানিফ পরিবহনের একটি বাস রংপুর জেলার পীরগঞ্জে ডাকাতির শিকার হয়। যাত্রীবেশে ডাকাতরা বাসে ওঠে চালক মনজুর হোসেনকে (৫৫) কুপিয়ে গুরুতর আহত করে বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে নগদ টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে যায়। চালক মনজুর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এই ঘটনায় বাসের সুপার পইমুল ইসলাম বাদী হয়ে পীরগঞ্জ থানায় মামলা করেন।
এমনই এক ডাকাত চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব)। গত ৪ সেপ্টেম্বর ১ ও ১৩ যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করে আশুলিয়া ও গাইবান্ধা থেকে ওই ডাকাতির সঙ্গে জড়িত নয়ন চন্দ্র রায়, রিয়াজুল ইসলাম লালু, ওমর ফারুক, ফিরোজ কবির, আবু সাঈদ মোল্লা ও শাকিল মিয়া নামে ছয়জনকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি ও লুট করা মোবাইল উদ্ধার করে র্যাব। এই ডাকাত দলের নেতা নয়ন চন্দ্র রায়।
রোববার (৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, এই ডাকাত দলের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে উত্তরবঙ্গগামী বাসে পরিকল্পনা করে ডাকাতি করতো। তারা গত ডিসেম্বর থেকে ৭/৮ টি ডাকাতি করেছে। পলাশবাড়ী থেকে পীরগঞ্জ ৪৮ কিলোমিটার মহাসড়ক নির্জন এলাকায় তারা ডাকাতি করতো।
তিনি বলেন, গত ৩১ আগস্ট রাতে ঢাকা হতে পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া হানিফ পরিবহণের একটি বাস রংপুর জেলার পীরগঞ্জ এলাকায় পৌঁছুলে দুর্ধর্ষ ডাকাতির কবলে পড়ে। ওই বাসে যাত্রীবেশী ডাকাত দলের সদস্যদের ছুরিকাঘাতে বাসের চালক মনজুর হোসেন গুরুতর আহত হযন এবং পরে মারা যান। এ ঘটনায় বাসের সুপারভাইজার মো. পইমুল ইসলাম বাদী হয়ে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন। ঘটনাটি সারাদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে খবরটি প্রচার হয়। এ চাঞ্চল্যকর হত্যাসহ ডাকাতির পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব-১ তাৎক্ষণিকভাবে হত্যাকারী ডাকাত দলের সদস্যদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে দ্রুততার সঙ্গে ছায়া তদন্ত শুরু করে ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শনিবার (৪ সেপ্টেম্বর) র্যাব-১ ও র্যাব-১৩ আভিযানিক দল রাজধানীর অদূরে আশুলিয়া ও গাইবান্ধায় অভিযান পরিচালনা করে বাসচালক হত্যাসহ ডাকাতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ৬ জনকে গ্রেফতার করে।

খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ৩১ আগস্ট রাত ৮টার দিকে হানিফ পরিবহণের একটি নন-এসি বাস (ঢাকা মেট্রো-গ-১৫-৩৮১০) ঢাকা হতে পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে গাবতলী ছেড়ে যায়। বাসটি সাভারে পৌঁছুলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ডাকাত দলের তিনজন (রিয়াজুল ইসলাম ওরফে লালু, আবু সাঈদ মোল্লা ও অপর একজন) এবং নবীনগর পৌঁছুলে ডাকাত দলের আরও তিনজন (শ্রী নয়ন চন্দ্র রায়, ওমর ফারুক ও ফিরোজ কবির) যাত্রীবেশে বাসে ওঠে। রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে বাসটি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার বিটিসি মোড় অতিক্রম করার পর বাসে যাত্রীবেশে থাকা ডাকাত দলের সদস্যরা ডাকাতির উদ্দেশ্যে বাসটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করে। প্রথমে তারা বাসের চালক মনজুর হোসেনকে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করে। এসময় চালক বাসটি ঘুরিয়ে আনার চেষ্টা করলে তারা আবার চালকের কাঁধে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে বাসটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর ডাকাত দলের সদস্য রিয়াজুল ইসলাম ওরফে লালু বাসটি চালাতে থাকে ও দলের অন্য সদস্যরা বাসে লুটপাট করতে করতে রংপুরের শটিবাড়ীস্থ ভাবনা ফিলিং স্টেশনে ইউটার্ন করে আবার উল্টো পথে রওয়ানা করে।
তিন জানান, পলাশবাড়ী পৌঁছার আগে ডাকাতেরা ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে পীরগঞ্জের চম্পাগঞ্জ হাইস্কুলের সামনে রাত ৩টার দিকে যাত্রীসহ বাসটি রেখে পালিয়ে যায়। এসময় ডাকাতরা যাত্রীদের মুঠোফোন ও নগদ ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা লুট করে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে গুরুতর আহত অবস্থায় বাসচালক মনজুর হোসেনকে পলাশবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কতর্ব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাবের এ মিডিয়া উইং কর্মকর্তা বলেন, তারা একটি সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সক্রিয় সদস্য। দলটির সদস্য ১০ থেকে ১২ জন। গ্রেফতার নয়ন চন্দ্র রায় ডাকাত দলের মূলহোতা। সে ডাকাত দলটি নিয়ন্ত্রণ করতো। দলের সদস্যরা দীর্ঘদিন উত্তরবঙ্গগামী বাসে সাধারণ যাত্রীবেশে উঠে ডাকাতি করে আসছিল। তারা গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ৭ থেকে ৮টি বাসে ডাকাতি করেছে। ইতোপূর্বে ডাকাত চক্রটি পলাশবাড়ী থেকে পীরগঞ্জ ৪৮ কিলোমিটার এলাকায় গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর রত্না স্পেশাল, ১ জানুয়ারি সিটিবাড়ি স্পেশাল, ১২ জানুয়ারি সৈকত পরিবহন, ৮ মার্চ শ্যামলী পরিবহন, ৪ এপ্রিল জায়দা পরিবহন ও ১৯ আগস্ট ডিপজল পরিবহনে ডাকাতি করছে বলে স্বীকার করেছে। সাধারণত, তারা পলাশবাড়ি থেকে পীরগঞ্জ মহাসড়কের নির্জন এলাকা বাস ডাকাতির জন্য বেছে নেয়। ডাকাতি করার পর তারা ফের আশুলিয়ায় ফিরে আসতো।
র্যাব জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার নয়ন চন্দ্র জানান, সে চক্রের মূলহোতা। চক্রের অন্য সদস্যরা আশুলিয়ায় বিভিন্ন গার্মেন্টসে খণ্ডকালীন চাকুরি, ক্ষুদ্র ব্যবসা, অটোচালকসহ বিভিন্ন পেশায় জড়িত ছিল। গ্রেফতার শাকিলসহ আরও কয়েকজন সদস্য গাইবান্ধায় বিভিন্ন পেশায় জড়িত। রিয়াজুল ইসলাম ওরফে লালু পেশায় ট্রাকচালক। সে তার অন্য সহযোগীদের সঙ্গে বাস ডাকাতির সময় বাসের চালকের পরিবর্তে নিজে বাস চালিয়ে ডাকাত সদস্যদের গন্তব্যে নিয়ে যেতো। শাকিল ডাকাতির স্থানে উপস্থিত থেকে তথ্য ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করতো। গ্রেফতার অন্য সদস্যরা সশরীরে ডাকাতিতে অংশ নিতো। গ্রেফতাররা একে অপরের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বাসে সাধারণ যাত্রীবেশে উঠে ডাকাতি করে আসছিল।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার আল মঈন বলেন, যাদের আমরা গ্রেফতার করেছি, তাদের বেশিরভাগের বাড়িই গাইবান্ধা ও রংপুর অঞ্চলে। পলাশবাড়ি-রংপুর-পীরগঞ্জ রুটের ৪৮ কিলোমিটার এলাকা সম্পর্কে ডাকাত দলের ভালো ধারণা ছিল। যে কারণে ডাকাতির জন্য এ এলাকাগুলো বেছে নিতো তারা। এসব রাস্তা কখন নিরিবিলি থাকে, সেটা জেনেই অধিকাংশ সময় তারা নাইট কোচে ডাকাতি করতো। চক্রটি দুটি স্পটে ওয়াচম্যান রাখতো। তাদের কাজ ছিল, রাস্তায় আশপাশের মানুষের আনাগোনা আছে কি-না বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আছে কি-না, সেটা লক্ষ্য রাখা। এসব সড়কের কোথাও সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকায় তাদের ধারণা ছিল, এখানে ডাকাতি করলে কেউ তাদের সনাক্ত করতে পারবে না।
এসব সড়কে অপরাধ দমনে র্যাবের কোনো পদক্ষেপ আছে কি-না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, র্যাবের পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশ টহল দিয়ে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিনিয়ত বিভিন্ন গাড়ি বা যাত্রীদের চেক করে থাকে। আমরা তাদের নজরদারির মধ্যে রেখেছি। এসব অপরাধীরা ডাকাতি দিন সন্ধ্যা থেকে বিভিন্ন সড়কে নজরদারি রাখতো। সুযোগ পেলেই তারা ডাকাতি করতো। যেহেতু পরিবহণ সেক্টর ও হাইওয়েতে ডাকাতি বেড়ে গেছে, আমরাও টহল জোরদার করেছি। হাইওয়ে পুলিশও নিশ্চয় তাদের টহল জোরদার করেছে।
ডাকাতিকালে কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হতো, জানতে চাইলে র্যাবের এ মিডিয়া উইং কর্মকর্তা বলেন, ডাকাতরা বেশিরভাগ সময় ছুরি ব্যবহার করেছে। ছুরি ব্যবহার করেই সবশেষ ডাকাতি সম্পন্ন করেছে তারা।
কালের আলো/ডিআরবি/এমএম