ভাষা-উদ্বাস্তু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোচদের কথকতা
প্রকাশিতঃ 10:44 am | September 01, 2021

জয়নাল আবেদীন
বাংলাদেশে বাস করা ৫০টির অধিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে কোচরা অনত্যম। ভাষা, সংস্কৃতি, দৈহিক অবয়ব এবং জীবিকায়নের ভিন্নতার কারণে অন্য নৃ-গোষ্ঠী থেকে একটু আলাদা সত্তার অধিকারী। তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও গোষ্ঠী সংগ্রাম স্বাতন্ত্র্যের দাবি রাখে। তবে সময়ের আবর্তে ভাষা ও বর্ণমালা হারিয়ে এখন ভাষা উদ্বাস্তু তারা।
বাংলাতেই কথা বলেন এখন। ফলে চিরায়ত প্রথা, রীতি ও সংস্কৃতি অনেকটাই লোপ পেয়ে গেছে। নৃবিজ্ঞানী বুকানন হ্যামিল্টনের মতে, কোচরা বৃহত্তর মোঙ্গলীয় নরগোষ্ঠীর বোডো শাখাভুক্ত। রোভারেন্ট অ্যাঞ্জেলসের মতে, কোচ, মেছ, বোডো, ধীমাল, গারো, হাজংরা আদি কাছারি জাতির বংশধর। গ্রিক পরিব্রাজক টলেমি খ্রিষ্ট জন্মের দ্বিতীয় দশকে কামরুপ অঞ্চলে কোচ জাতিগোষ্ঠীর বসবাসের কথা বলেছেন। কোচরা এক পর্যায়ে কামরুপ থেকে কোচবিহারে ছড়িয়ে পড়ে। কোচবিহার নামের সঙ্গে মিল রেখে জাতিগোষ্ঠীর নামকরণ হয় কোচ। এদের ক্ষুদ্র একটি অংশ পরবর্তী সময়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহে বসতি গাড়েন। চতুর্দশ শতকে শেরপুরের দশকাহানিয়া পরগনার গড় জরীপাকে রাজধানী করে রাজ্য গড়েন তারা।
বর্তমান ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর এবং মধুপুর গড়ের মধুপুর, ভালুকা, ঘাটাইল, সখিপুর, কালিয়াকৈর ও সাভার উপজেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন কোচরা। আদিবাসী নেতা খগেন্দ্র হাজংয়ের ‘কোচজাতির ইতিহাস’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, কোচরা বর্মন, বংশী, হাজং ও বানাই নামেও পরিচিত। ভাষাচার্য ড. গিয়ার্সন কোচদের ছয়টি শাখার কথা বলেছেন। কোচদের একই বংশে বিবাহ নিষিদ্ধ। উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ঘরজামাই প্রথা ছিল। যৌতুক প্রথা এখনো সমাদৃত। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার হলেও এখনো মায়ের গোত্রনাম ব্যবহার করেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও বর্ণ হিন্দুরা এদেরকে ছোটজাত মনে করেন। দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতী পূজার পাশাপাশি যোগমায়া ও দেবী কামাখ্যার পূজা করেন। মধুপুর বনাঞ্চলের কোচরা বন দুর্গার পূজা করেন। বড় গাছের ছাল বিশেষ কায়দায় তুলে দুর্গার প্রতিচ্ছবি আঁকেন। সেই প্রতিচ্ছবিতে রংয়ের প্রলেপ দিয়ে বনদুর্গার বিমূর্ত স্পষ্ট করেন।
কোচদের ভাষার নাম থার। তবে বর্ণমালা না থাকায় লিখিত রূপ নেই। ১৯৯১ সালের সরকারি জনগণনায় বাংলাদেশে ১৬ হাজার ৫৫৬ জন কোচ দেখা যায়। এরমধ্যে টাঙ্গাইলে সবচেয়ে বেশি। ৮ হাজার ৪৪৯ জন। ২০১৫ সালে বেসরকারি সংস্থা সেডের গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘কোচ অব মধুপুর’ গ্রন্থে দেখা যায়, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও গাজীপুরে কোচদের সংখ্যা প্রায় ৩২ হাজার। টাঙ্গাইলের মধুপুরে পাহাড়ি ৩০ গ্রামে কোচের সংখ্যা ৩ হাজার ৪২৭ জন। এদের ৮৯ শতাংশ ভূমিহীন। শিক্ষার হার ৪৮ দশমিক ০৫ শতাংশ। মূল পেশা দিনমজুরি। বাঁশ-বেতের কাজও করেন। মধুপুর উপজেলার কামারচালা গ্রামের অমূল্য চন্দ্র বর্মন জানান, ৪৭ থেকে ৭৫ চার দফা দাঙ্গায় কোচদের অনেকেই ভারতে যান। ফিরে এসে বাড়িঘর, জমিজমা ফেরত পাননি। বেশির ভাগই বনের খাস জমিতে বাস করেন। সাড়ে তিন দশকে সরকার বনাঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন, পুনর্বাসনে তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। প্রথমটি ৮৬ সালে বনশিল্প উন্নয়ন সংস্থার ২০০ কোটি টাকায় ৭ হাজার একরে রাবার প্রকল্প। ৯৩ সালে বাণিজ্যিকভাবে উত্পাদন শুরু হয়। পীরগাছার সত্যেন কোচ জানান, এ খাতে আড়াই হাজার লোকের কর্মসংস্থান হলেও একজন কোচেরও চাকরি হয়নি। অথচ বনাঞ্চল থেকে উচ্ছেদের সময় আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে, রাবার বাগানের চাকরিতে তারা অগ্রাধিকার পাবেন। বনাঞ্চলে দ্বিতীয় দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প সামাজিক বনায়ন। ৮৯ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণে প্রকল্প শুরু। বন মন্ত্রণালয়ের তিন প্রকল্পের কাজ শেষ। প্রকল্পে ব্যয় ১৫০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ কোচ সমিতির সভাপতি গৌরাঙ্গ কোচ জানান, বনবিভাগ তিন দশকে প্রায় ২০ হাজার অংশীদার বাছাই করে ৭ হাজার একরে সামাজিক বনায়ন করেন; কিন্তু একজন কোচকেও সামাজিক বনায়নের অংশীদার করা হয়নি। বনাঞ্চলে সরকারের তৃতীয় দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচি ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উন্নয়ন প্রকল্প।’ দেখাশোনা করেন স্থানীয় প্রশাসন। ৯৭ থেকে ২০২১ ব্যয় ২৫ কোটি টাকা।
আমলিতলা গ্রামের রাখাল বর্মন জানান, এ প্রকল্পের কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন চোখে পড়ে না। প্রকল্পের টাকার ব্রিজ-কালভার্ট দুই বছরও টিকেনি। ফলোআপ না থাকায় বিতরণ করা গবাদিপশু বেচাবিক্রি করে খেয়েছেন দরিদ্র কোচরা। সাইনামারি গ্রামের পূর্ণিমা বর্মন জানান, কোচ পল্লিতে কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। খ্রিষ্টান মিশনারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোচ শিশুরা গারো ভাষায় প্রাকপ্রাথমিকে পড়েন। অনটন আর ভাষা দুর্বোধ্যতার কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডিতেই কোচ শিশুরা ঝরে পড়ে। কোচ পাড়ায় এখনো পলিথিনে ছাওয়া অস্বাস্থ্যকর খোলা লেট্রিন মুখ ব্যাদান করে থাকে। তিন-চার বাড়ি মিলে একটি নলকূপ। পাড়ায় কমিউনিটি ক্লিনিক নেই। আমাশয়, ডায়রিয়া, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর নিত্যসঙ্গী। সরকারি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মীরা অন্ত্যজ কোচপাড়ায় সহজে পা মাড়ায় না। বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও প্রসূতি ভাতার সঙ্গে তারা পরিচিত নন। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের বসতঘরও পায়নি কোচরা।
সমাজবিজ্ঞানী ড. আবিদ হাসান এক গবেষণায় জানান, সরকার এখন এসডিজি অর্জনের জন্য কাজ করছেন; কিন্তু এসডিজির মূল স্লোগান ‘লিভ নো ওয়ান বিহাইন্ড’ কথাটি বাস্তবায়ন করতে হলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কোচদের উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
লেখক: শিক্ষক ও সংবাদকর্মী