আলজাজিরার হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট এবং আমার কিছু কথা…

প্রকাশিতঃ 10:16 pm | February 03, 2021

আশিকুল পাঠান সেতু:

প্রথমেই আলজাজিরা নামক কাতারভিত্তিক টিভি চ্যানেলের দীর্ঘকালীন বার্লিনের সংবাদদাতা আক্তাম সুলিমানের এই সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ে এক বক্তব্য দিয়ে শুরু করছি। ২০০৪-২০১১ সাল অবধি আল জাজিরার সংবাদদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসা এই রিপোর্টার ২০১২ সালের শেষদিকে বলেছিলেন যে তিনি অনুভব করেছেন যে তাকে আর স্বাধীন সাংবাদিক হিসাবে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন “আরব বসন্ত শুরুর আগে, আমরা পরিবর্তনের জন্য একটি কণ্ঠস্বর ছিলাম, অঞ্চলজুড়ে সমালোচক এবং রাজনৈতিক কর্মীদের মঞ্চ। এখন, আল-জাজিরা একটি প্রোপাগান্ডা প্রচারক হয়ে উঠেছে। আল-জাজিরা প্রতিটি দেশেই একটি স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে যেখান থেকে তারা সাংবাদিকতার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নয়, বরং কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের স্বার্থের ভিত্তিতে রিপোর্ট করেছে। একজন প্রতিবেদক হিসাবে আমার সততা বজায় রাখতে আমাকে ছাড়তে হয়েছিল।” এই সেই আল জাজিরা যা বিভিন্ন সময়ে নানা দেশে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়ার অভিযোগে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিলো। এখনো পর্যন্ত বিশ্বের ৫টি দেশে সম্প্রচার নিষিদ্ধ এই চ্যানেলের।

আলজাজিরায় প্রচারিত তথাকথিত ডকুমেন্টারি “দ্য হিডেন ইজ মোর ইমেনেস” কে “পরিষ্কার এবং স্পষ্ট মিথ্যা ও মিথ্যাচার” দ্বারা পরিপূর্ণ হিসেবে অভিহিত করেন বাহরাইনের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী শায়খ খালিদ বিন আহমেদ বিন মোহাম্মদ আল খলিফা। এর জেরে ওই দেশের তথ্যমন্ত্রী নাবিল বিন ইয়াকুব আল-হামার ২০০১ সালের ১০ মে আল জাজিরার সংবাদদাতাকে দেশের অভ্যন্তরীণ থেকে খবর দেওয়া নিষিদ্ধ করে বলেছিলেন যে স্টেশনটি ইসরায়েলের দিকে এবং বাহরাইনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট ছিল।

১৯৯৯ সালে আল-কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার প্রচার করে চরম বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলো কাতারভিত্তিক সম্প্রচার মাধ্যম আলজাজিরা টেলিভিশন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মাধ্যমে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সংহতি বিনষ্টের মিশন নিয়েছে কথিত এ গণমাধ্যম।

এই জঘন্যতম পক্ষপাতদুষ্ট এবং বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদকে লালনকারী তথাকথিত চ্যানেলটি গত ১লা ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, সেনাপ্রধান, পুলিশপ্রধান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে দীর্ঘসময় চক্রান্তের মাধ্যমে একটি ড্রামা প্রচার করে। এর শিরোনামেই উঠে আসে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রের অন্যতম শক্তি সেনাবাহিনী’র প্রধানকে টার্গেট করে নির্দিষ্ট কোন গোষ্ঠীর এজেণ্ডা বাস্তবায়নে হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট এর প্রজেকশনই মূল এবং একমাত্র উদ্দেশ্য।

অথচ সেনাবাহিনী নিজস্ব আইনে পরিচালিত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালনকারী প্রতিষ্ঠান। আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সেনাবাহিনী নিয়ে বিতর্ক তোলার নজির নেই। আল জাজিরা সকল নীতি উপেক্ষা করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছে। যা গর্হিত অপরাধও বটে।

১ ঘন্টা ২০ সেকেন্ডের এই ড্রামা তে বলা হয়েছে জেনারেল আজিজ আহমেদ হাঙ্গেরিতে বসবাসকারী জুলকারনাইন সায়ের ওরফে সামিকে ইমেইল-টেক্সট এর মাধ্যমে হুমকি দিয়েছেন। যার স্ক্রিনশট এ চোখ বুলালেই বোঝা যায় আলজাজিরা’র প্রযোজকদের নির্দেশনায় নিজেদের প্রসবকৃত গল্পের প্রিন্টেড ভার্সন এগুলো।
এবার আসি সামি নামক সদ্য ভিনগ্রহ থেকে আগত আগন্তুক’র পরিচয় সম্পর্কে।

একজন জন্মগত অপরাধী যিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসেছেন বলে জানা গেছে। মাদক বিক্রির সময় তাকে একবার বাংলাদেশে র‌্যাব আটক করেছিল। তিনি বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির ক্যাডেট ছিলেন যিনি মাদকাসক্তি ও নৈতিক স্খলন জনিত মামলার জন্য কমিশনের সম্মুখীন করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে জালিয়াতির কারণে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের (এখন অবসরপ্রাপ্ত) কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শ্বশুর এর কাছ থেকে তিনি যৌতুক নিয়েছিলেন, সেই টাকা দিয়ে বুদাপেস্টে ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবং একসময় তার ব্যবসায়ের বিষয়ে শ্বশুরবাড়ির সাথে ঝগড়া শুরু করেছিলেন। তার বাজে চরিত্র এবং অনৈতিক অভ্যাসের কারণে ব্যবসায় লসের সম্মুখীন হচ্ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ছাড়ার আগে মানসিক রোগী হিসেবে গণ্য ছিলেন। তিনি ছিলেন মরহুম লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল বাসিত, এএমসি এর পুত্র, যিনি মৃত্যুর আগে অসন্তুষ্ট জীবনযাপনের জন্য তাঁর ছেলে সাইয়ের জুলকার্নাইনকে অস্বীকার করেছিলেন। যাতে সাইয়ের ডেভিড বার্গম্যানের তদন্তকারী দল তাকে যে বিবরণী করতে বলেছে তা বর্ণনা করেছিল। এটি মঞ্চস্থ একটি নাটক ছিল। যেহেতু তিনি একজন আর্মি অফিসারের ছেলে, সুতরাং যে কোনও আর্মি ব্যক্তি হাঙ্গেরিতে যান, খুব সহজেই এই খুব ধূর্ত জুলকারনাইন সাইয়ের খানকে বিশ্বাস করেন।

জাতীয় ঐক্য ফ্রন্টের প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল হোসেনের জামাতা ডেভিড বার্গম্যান এই ড্রামার মূল কারিগর এটা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

আসুন তার পরিচয়টা একটু ঘেটে দেখি। এই সেই ডেভিড বার্গম্যান যে বাংলাদেশে শহীদের সংখ্যা ৩-৫ লাখ লিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল কর্তৃক অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতাকারী জামায়াতের এই পেইড লবিস্ট অবস্থা বেগতিক বুঝে বাংলাদেশ ছেড়ে গিয়ে দ্বিগুণ উদ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্রে মনোনিবেশ করেছে।

এরপর আলোচনার বিষয়বস্তু তথাকথিত ‘আহমেদ ক্ল্যান’। খালেদা জিয়ার ক্ষমতার প্রথম হানিমুন পিরিয়ড। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীর দল ফ্রিডম পার্টির ক্যাডাররা অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে মহড়া রক্তের হোলিখেলায় মেতেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টায় ৩২ নম্বরের বাড়িতে একাধিকবার আক্রমণ করেছে। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে বীরের বেশে খোলা জিপে ঘুরে বেড়াচ্ছে ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর এলাকায়। ঠিক তখনই নেত্রীর চারপাশে ঢাল হয়ে দাঁড়ায় আনিস, হারিস, জোসেফরা। আল জাজিরার বর্ণনায় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে প্রকাশ করা আদতে খুনীদের দলনেতাকে তিন ভাই মিলে নাকি হত্যা করেছে। এরপর খালেদা জিয়ার মদদপুষ্ট প্রশাসন তাদের শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দিয়ে জেলখানায় পুরে দিলো। তৎকালীন অবিভক্ত ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর ছাত্রলীগের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে আসা তোফায়েল আহমেদ জোসেফ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তকমা মাথায় নিয়ে দীর্ঘ ২০ বছর তারুণ্য আর যৌবনের সময়টুকু পার করলেন জেলখানার চার দেয়ালের ভেতর। বাকি দুই ভাই হলেন দেশান্তরী। আলজাজিরা সেই ইতিহাসকে সামনে এনে মূলত বর্তমান চৌকস সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদকে নিজেদের অপকর্ম বাস্তবায়নের মূল নিশানা করতে চাইল। তোফায়েল আহমেদ জোসেফকে যেখানে রাষ্ট্র ক্ষমা করেছে এবং তিনি একজন স্বাধীন দেশের নাগরিক সেখানে আলজাজিরা তাকে ফেরারি বা সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে নিজেরা সাংবাদিকতার নীতি কতটুকু ভঙ্গ করলো সেটাও বিবেচ্য বিষয়।

সেনাপ্রধানের ছেলের বিয়ের কিছু ভিডিওক্লিপ আর স্টিলপিকচারে তার ভাইদের উপস্থিতি দেখিয়ে বিরাট এক ঘটনা হিসেবে দেখালো। কারো বিয়েতে তার রক্তের সম্পর্কের চাচারা উপস্থিত থেকে কি বিশাল অপরাধ করলো তা আমার বোধগম্য নয়। তাছাড়াও ওই অনুষ্ঠানের যে ভিডিওক্লিপ সংযুক্ত করা হয়েছে সেখানে কোথাও আলজাজিরার তথাকথিত অপরাধীদের দেখা যায়নি। ভিন্ন পোশাকে ভিন্ন অনুষ্ঠানের কিছু স্থিরচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে যা এই প্রযুক্তির যুগে টেমপারড বা এডিটেড কিনা সেটা নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।

আলজাজিরার প্ল্যান্টেড ভিডিওক্লিপে হারিস আহমেদের কিছু বক্তব্য দেখিয়ে প্রমাণ করতে চাইলো রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান তথা হাইঅফিসিয়ালদের নিয়ন্ত্রণ তারই হাতে। অথচ ডকুমেন্টারির শুরুতেই সেই জুলকারনাইন সায়ের ওরফে সামি’র বরাত দিয়ে একই ব্যক্তিকে ‘সাইকোপ্যাথ’ হিসেবে সম্বোধন করে। তবে প্রশ্ন থেকে যায় একজন অস্বাভাবিক ব্যক্তির বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের বিতর্কিত করার চেষ্টা করে সামি বা আলজাজিরা কি নিজেরা অপরাধ করলো না?

সবশেষে একটি কথা আগুনসন্ত্রাস, তথ্যসন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, বিদেশে বসে গুজবসন্ত্রাস সকল রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের কুশীলবরা যে নব্য ‘মিশন উইন্টার প্রোপাগান্ডা’ শুরু করেছে তা অতীতের ন্যায় মুখ থুবড়ে পড়বে এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা এবং ইতিহাস তাই বলে। সুতরাং বাংলাদেশের উন্নয়নের জয়যাত্রা যারা ভঙ্গ করতে চায় তাদের কানখুলে শুনে রাখা উচিৎ বঙ্গবন্ধুকন্যা যতদিন বেচে আছেন এবং তার সৈনিকেরা যতক্ষণ জাগ্রত আছে ততক্ষণ স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির কোনো মিশনই আলোর মুখ দেখবে না।