আবার সতর্কতা
প্রকাশিতঃ 10:46 am | September 29, 2020

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা :
করোনাভাইরাসে লণ্ডভণ্ড পৃথিবী এখন দ্বিতীয় ঢেউ তথা আরেক আক্রমণের আশংকা করছে। এর মধ্যেই বৃটিশ প্রধামন্ত্রী বরিস জনসন করোনা মহামারির কারণে তার দেশে কড়াকড়ি নানা নির্দেশনা জারি করেছেন। ছয় জনের বেশি এক সাথে হতে পারবে না, মাস্ক না পরলে ২০০ পাউন্ড জরিমানা, পানশালাসমূহ রাত দশটার মধ্যে বন্ধ করে দেয়াসহ অনেক প্রকার স্বাস্থ্যবিধি আরোপ করেছে বৃটিশ সরকার। স্পেনে নতুন করে লকডাউন হয়েছে।
শীত আসছে, তাই বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে সতর্ক থাকার তাগিদ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর আমলারা বসে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছেন। বলেছেন, লকডাউন না সতর্ককতা অবলম্বন করা হবে, জনগণ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মানে সেজন্য নজরদাড়ি বাড়ানোর পরামর্শ এসেছে সভায়।
এর মধ্যেই গত মঙ্গলবার সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে। গত ৮ মার্চ সরকারিভাবে দেশে করোনার রোগীর উপস্থিতি জানানো হয়। বাংলাদেশে মৃত্যু হার কম বলা হলেও গত ৪ এপ্রিল থেকে নিয়মিত মৃতুর সংবাদ এসেছে। গত কয়েক মাস ধরে প্রতিদিন মৃত্যু সংখ্যা উঠানামা করেছে ৩০ থেকে ৫০ এ। তবে কখনও কখনও মৃতের সংখ্যা ৩০ এর নিচেও নেমেছে। সংক্রমণ শনাক্তের পর থেকে প্রথম এক হাজার মৃত্যু হয়েছিল ৯৫ দিনে, দ্বিতীয় এক হাজার ২৫ দিনে। তৃতীয় এক হাজার পূর্ণ হয় ২৩ দিনে আর চতুর্থ ও পঞ্চম এক হাজার হয়েছে ২৮ দিনে।
প্রধানমন্ত্রী যখন সবাইকে সচেতন হতে পরামর্শ দেন, তখন বুঝতে হয় পরিস্থিতি আপাত দৃষ্টিতে স্বাভাবিক হলেও আসলে স্বাভাবিক নয়। এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে সারাবিশ্ব। দেশে দেশে বাড়ছে বা কমছে মৃত্যুর সংখ্যা। সংক্রমণ ঠেকানোর কৌশল ব্যর্থ হচ্ছে। এখনও টিকা বাজারে আসেনি। ঠিক মতো কিছু বুঝে উঠার আগেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ভাইরাসে, শরীর অসুস্থ হচ্ছে এবং মারাও যাচ্ছে। করোনাভাইরাস এখন এক আতঙ্কের নাম। এখনও অবধি নিশ্চিত করে এর প্রতিকার বা ওষুধের খোঁজ মেলেনি। তাই চেষ্টা করা হচ্ছে মানুষকে যতটা পারা যায় ঘরে আটকে রেখে রোগ থেকে দূরে রাখতে।
যার অর্থ আছে, যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম চিকিৎসা চোখের পলকে কিনে নিতে পারেন, তিনিও আজ অসহায়। করোনাভাইরাস কিছু বিষয় পরিষ্কার করল আমাদের কাছে। সামাজিক ক্ষমতার কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে, অর্থ আর নিরাপত্তার প্রতীক বা নিশ্চয়তা নয়, উৎসব করতে হবে মানুষের মিলন ছাড়াই। আমরা সবাই জানি উৎসব দুঃখকে ছেড়ে সুখকে আলিঙ্গন করে, উদাসীনতাকে ছেড়ে উচ্ছলতাকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু এখন উৎসবেও মন উদাসীন।
এখন আর সেই সব আবেগ নেই। এটাই নয়া স্বাভাবিকতা। বিমান চলাচল শুরু হলেও ব্যবসায় গতি নেই। দেশে দেশে নানা প্রকার ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। বিশ্বব্যাপী সব ঐতিহ্যবাহী ফেস্টিভ্যাল বা উৎসব স্থগিত। খেলাধুলা হচ্ছে দর্শবিহীন স্টেডিয়ামে।
একটি নিজস্ব কঠোরতা আমাদের মাঝে যারা এই ভয়ংকর ছোঁয়াচে রোগ সম্পর্কে জানে। তারা নিজেদের বন্দী করছে ঘরের ভেতর। এ যেন স্ব-ঘোষিত কার্ফ্যু। যে ইউরোপ, যে আমেরিকা বা কানাডা, যে জাপান নতুন নতুন সব জাগরণে উদ্দীপ্ত থাকে সব সময় সেসব দেশ এখন আতঙ্কের প্রহর গুণছে। করোনা-কাঁটায় সঙ্গীন অবস্থা বিশ্ব অর্থনীতির। আমরা আমাদের স্বাভাবিক কাজ করতে পারছি না। অফিস আদালত খুললেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হচ্ছে আমাদের। অনেক রেস্তোঁরা এখনও বন্ধ, এখনও সব ডাক্তার চেম্বার খুলেন নি।
সবার মাঝে অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠ। ঘরে থাকতে থাকতে শারীরিক, মানসিক সব রোগ ঘিরে ধরছে আমাদের, চিকিৎসা পাওয়ার উপায় সীমিত, কারণ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যস্ত করোনা রোগী নিয়ে। আর্থিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। শ্রমজীবী মানুষের বড় অংশ কাজ হারিয়েছে। যারা ব্যক্তিখাতে কাজ করতো, তাদের অনেকেরই রোজগার বন্ধ ছিল, সঞ্চয় ভেঙ্গে তারা চলেছে। মানুষের অনিশ্চয়তা এখনও কাটেনি। তারা আজ ভীত তাদের আগামী নিয়ে।
নতুন করে করোনার ঢেউ আসছে। আবার স্বাস্থ্যবিধি, আবারও শারীরিক ও সামাজিক দূরত্বের আহ্বান। এসব করতে যতটা কষ্টই হোক না কেন, মনে রাখতে হবে এটাই নয়া স্বাভাবিকতা। বিচ্ছিন্নতা, তবুও নৈকট্যের কথা বলছে এই করোনা কালের পৃথিবী। সামাজিক আর শারীরিক দূরত্ব নাগরিক মনে নতুন এক বিচ্ছিন্নতা জন্ম দিয়েছে। এখন আমাদের জানতে হচ্ছে দূরে থেকেও সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা যায় কি করে। করোনায় ঘরবন্দী থেকে থেকে বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি প্রবীণদের আর শিশুদের। তাদের কথা আরও অন্তর দিয়ে ভাববার সুযোগ করে দিল এই ভাইরাস।
ভয় মানুষকে, ভয় জনসমাবেশকে। মৃত্যুভয় বা অস্তিত্ব সঙ্কটের এমন সর্বজনীন পরীক্ষায় আগে বসতে হয়নি মানুষকে। এই পরীক্ষা আরও অনেকদিন দিয়ে যেতে হবে। ওষুধও আবিষ্কৃত হয়নি, টিকাও বেশ দূরে। তাই নিজস্ব সাবধানতাই ভরসা।
লেখক : সাংবাদিক।