বেকারত্ব রুখবে সম্ভাবনার পর্যটনশিল্প
প্রকাশিতঃ 9:30 am | September 07, 2020

মো. শাহ জালাল মিশুক :
করোনাভাইরাস সারা দুনিয়ার অর্থনীতিতে যে ধস নামিয়েছে তা দু’টি মহাযুদ্ধের সময়ও অনুভূত হয়নি। ইতিহাসে বারবার একাধিক দেশ বা এলাকায় মহামারিতে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ সংহার হলেও কখনো বিশ্বজুড়ে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। এবার সারা দুনিয়া করোনা নামের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুজীবের ভয়াল আগ্রাসনের শিকার। বিশেষ করে দ্রুত অগ্রসরমান বাংলাদেশের অর্থনীতি করোনার প্রভাবে পড়েছে নাজুক অবস্থায়।
বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, করোনায় বাংলাদেশের প্রায় ১০ কোটি ২২ লাখ মানুষের আয় কমে গেছে৷ আর পরিবার হিসেবে আয় কমেছে শতকরা প্রায় ৭৪ ভাগ পরিবারের। এখন প্রধান কাজ হলো আয় যেন না কমে তার ব্যবস্থা করা। আর সেটা না করা গেলে দারিদ্র্য আরো বাড়বে।
উন্নয়নশীল বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা কয়েক বছর যাবত অব্যাহত আছে। তবে উন্নয়নের এই ধারাকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করে দেশের বেকার সমস্যা। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বেকারত্বও বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ‘২০১০ সালে বেকার সংখ্যা ছিল ২০ লাখ, ২০১২ সালে ২৪ লাখ, ২০১৬ সালের দিকে ২৬ লাখ।’ বৃদ্ধির এ ধারা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, ২০২০ সালে বেকার সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ভাষ্যমতেও এখন ৩০ লাখের বেশি বেকার আছে বাংলাদেশে। তবে এই সমস্যাটা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে করোনা। করোনার এই সংকটকালে বাড়ছে বেকারত্ব। গত ২৬ মার্চ সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সব কিছু বন্ধ করে দিলেও মানুষের জীবিকার কথা ভেবে শিথিলতার পথ বেছে নিতে হয়েছে। তবু সব ধরনের প্রতিষ্ঠান চালিয়ে নিতে পারছে না তাদের কার্যক্রম। চলছে সীমিত আকারে। এতে বাধ্য হয়ে কর্মী ছাঁটাই করতে হচ্ছে। যা বেকারত্বকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
মানবসভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মানুষ যুগে যুগে সব ধরনের দুর্যোগ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। করোনা পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল করা ও কর্মসংস্থানের মূল উপায় হতে পারে পর্যটনশিল্প। বাংলাদেশের জন্য করোনা পরবর্তী সময়ে পর্যটনশিল্প অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে মূল্যবান ভূমিকা পালন করতে পারে। বর্তমানে পৃথিবীর ১০টি কর্মসংস্থানের মধ্যে একটি কর্মসংস্থান তৈরি হয় পর্যটন খাতে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটনশিল্পের মোট অবদান ছিল ৮৫০ দশমিক ৭ বিলিয়ন টাকা। আর এইখাতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে মোট ২৪ লাখ ৩২ হাজার।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতুলনীয়। বাংলাদেশের মতো ষড়ঋতুর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এদেশে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকত- কক্সবাজার, পৃথিবীর একক বৃহত্তম জীববৈচিত্র্যে ভরপুর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল- সুন্দরবন, একই সৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকনের স্থান সমুদ্রকন্যা- কুয়াকাটা, দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সবুজ রঙের নয়নাভিরাম চারণভূমি- সিলেট, আদিবাসীদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি ও কৃষ্টি আচার-অনুষ্ঠান সমৃদ্ধ উচ্চ সবুজ বনভূমি ঘেরা- চট্টগ্রাম পার্বত্যাঞ্চল এবং সমৃদ্ধ অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তরাঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো। ফলে স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা অপরিসীম।
করোনা পরবর্তী সময়ে বিশ্বে পর্যটকদের চাহিদা পরিবর্তন হবে। আগামীতে বিশ্বের মোট পর্যটকের প্রায় ৭০ শতাংশ ভ্রমণ করবে এশিয়া অঞ্চলে। সেই দিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। অর্থাৎ পর্যটনশিল্পের সবটুকু সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে রোল মডেল হতে পারে। পাশাপাশি ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পর্যটনশিল্প বাংলাদেশের জন্য হয়ে উঠতে পারে অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে। সরকারের উন্নয়ন ভাবনায় পর্যটনশিল্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে, যে কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আমাদের পর্যটনশিল্প এগিয়ে যাছে তা আরো বেগবান করা গেলে এই খাতে আরো উন্নতি করা যাবে। পাশাপাশি করোনা পরবর্তী বাংলাদেশে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টির মাধ্যমে করোনাকালীন বেকারত্ব ঘোচাতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সদস্য (মেম্বারশিপ অ্যাফেয়ার্স), চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার, বিআইপি।