করোনা মোকাবিলায় গবেষকদের ভূমিকা

প্রকাশিতঃ 10:42 am | April 01, 2020

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর :

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট (বায়োটেকনোলজি, মাইক্রোবায়োলজি ও বায়োসায়েন্স) গবেষকদের এগিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। মহামারি এ করোনাভাইরাস প্রতিকারে কার্যকরী ওষুধ, প্রতিষেধক ও সরঞ্জাম আবিষ্কারে আপনারা অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারেন। আপনাদের উদ্ভাবনী শক্তি ও গবেষণায় জাতি করোনাভাইরাস রোধে কাঙ্ক্ষিত দিশা পেতে পারে। জানা মতে, দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষায়িত ল্যাবে করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণার সক্ষমতা ও উপযুক্ত পরিবেশ আছে। এক্ষেত্রে ইউজিসি প্রয়োজনীয় গবেষণা সহায়তা প্রদান করতে বদ্ধ পরিকর।

দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়ার জন্য সংশিষ্ট গবেষকদের বিনীতভাবে অনুরোধ করছি। গবেষকগণ দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে গবেষণার মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন। দেশের এ দুটি খাতে নতুন নতুন গবেষণায় তারা অনবদ্য অবদান রেখে চলেছেন। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষায়িত বিভাগ, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের গবেষকগণ করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারেন। করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষক সমাজ এক্ষেত্রে অনলাইন প্লাটফর্মে প্রয়োজনীয় জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম, স্যানিটাইজার তৈরির সহজ পদ্ধতি, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তা বিষয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেন।

বাংলাদেশ সরকার ও ইউজিসি করোনাভাইরাস সংক্রান্ত কাজে আপনাদের যথাযথ সহযোগিতা প্রদান করবে। করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণার জন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষক সুনির্দিষ্ট গবেষণা প্রস্তাব দিলে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে। ইউজিসি এ ধরনের গবেষণা প্রস্তাবের অপক্ষোয় আছে।

উল্লেখ্য, হেকেপ প্রকল্পের আওতায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিছু উন্নত ও আধুনিক ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। আমার বিশ্বাস, এসব ল্যাবে করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণার যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা রয়েছে। তবে করোনাভাইরাস গবেষণার জন্য এসব ল্যাবের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দেশীয় ল্যাবে করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা পরিচালনা অত্যাবশ্যক। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বজায় রেখে জীবপ্রযুক্তি বিশারদগণ করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা করে জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে অবদান রাখবেন এ প্রত্যাশা রইল।

পাশাপাশি, দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের সম্মানিত চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বজায় রেখে আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে অনুরোধ করবো। চিকিৎসক সম্প্রদায় তাদের মেধা, মনন ও পরামর্শ স্বাস্থ্যখাতে সরকারকে সাফল্য এনে দিয়েছেন। আশা করি এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। জাতির সংকটে তারা নিরলস প্রচেষ্টা, সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তার জন্য ধন্যবাদ জানাই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস রোগের ভয়াবহতায় একে বৈশ্বিক মহামারি অ্যাখা দিয়েছে। কাজেই জনসাধারণকে অনুরাধ করবো ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, মাস্ক পরিধান করা, সাবান, স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা। সর্বোপরি নিজেকে নিরাপদ রাখা এবং গুজব থেকে সাবধানতা অবলম্বন করা। এক্ষেত্রে প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়ায় উত্তম।

আইইডিসিআরের তথ্য মতে, দেশে এখন মোট ৪৯ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত। ইতোমধ্যে আমরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পাঁচজনকে হারিয়েছি। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার উদ্বেগজনক। এর বিস্তার এখনই রোধ করা না গেলে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।

অবশ্য সরকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগামী মাসের ৯ তারিখ পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে। করোনাভাইরাসের বিস্তাররোধে সারাদেশে সব ধরনের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মাদারীপুরের একটি উপজেলা লকডাউনও করা হয়েছে।

বদলে যাবে গবেষণার বিষয়বস্তু ও গতিপথ

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং মানুষের চাহিদার নিরিখে গবেষণা এগিয়ে যায়। পরিবর্তন হয় গবেষণার গতিপথ ও বিষয়বস্তু। সেই প্রথম শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে গতিপথ কীভাবে বদলে গেছে সেটা আমরা দেখেছি। আমরা এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে বাস করছি যার গবেষণার বিষয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানো টেকনোলজি ও বায়োটেকনোলজি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে সমাজ ও বিশ্ব আমাদের ধারণার বাইরেও পাল্টে যাবে। এ যুগে রোবটপ্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে, যেহেতু মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, এখন রোবট আমাদের চাহিদা ও প্রত্যাশা সবকিছুই পূরণ করতে পারে।

বর্তমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে গবেষণায় রোবটিকস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। দেশে দেশে এ দুটি বিষয়ে প্রচুর গবেষণাও হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যবসায়িক স্বার্থে বর্তমানে গবেষণা হয়ে উঠছে ফলাফল ও বাণিজ্যনির্ভর। এখনকার গবেষণার মূল বিষয় হচ্ছে মানুষের জীবন গতিময়, সহজ ও আরামদায়ক করা এবং বাণিজ্য নিশ্চিত করা। কোনোভাবেই মানুষের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সাম্প্রতিককালের গবেষণার মূল উদ্দেশ্য নয়। আমাদের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল এই বিশ্বের স্থিতিশীলতার বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

মহামারি করোনাভাইরাস আমাদের কঠিনভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছে মানুষের সুরক্ষা ও নিরাপদ থাকার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বায়োটেকনোলজি যতটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা তার তুলনায় অনেক কম গুরুত্ব পাচ্ছে। বায়োটেকনোলজি গবেষণার উৎকর্ষের অভাবে সারাবিশ্ব করোনাভাইরাস মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। করোনাভাইরাস থেকে কঠিন শিক্ষার কারণে বদলে যাবে গবেষণার বিষয় ও গতিপথ। আমার মতে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আগামীর গবেষণায় প্রাধান্য পাবে বায়োসায়েন্স এবং বায়োটেকনোলজি। কারন পুরো বিশ্ব বুঝে গেছে মানবজাতির সুরক্ষা এবং বেঁচে থাকার চাইতে বড় কিছু নেই।

করোনাভাইরাস সংকট পরবর্তী আমাদের গবেষণার গতিপথ অবশ্যই পরিবর্তন হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে কোন দেশ প্রযুক্তির দিক থেকে এগিয়ে আছে সেটি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে না বরং বিবেচ্য বিষয় হবে এ ধরনের গবেষণায় কে বেশি গুরুত্ব ও সময় দিচ্ছে এবং মেধা ব্যয় করছে।

আগামীর গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য হবে মানুষের জীবনকে গতিময় ও সহজ করা নয় বরং মানুষের জীবনের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমি বিশ্বাস করি গবেষণায় নাটকীয় মাত্রায় পরিবর্তন ঘটবে। আমাদের গবেষণায় অবশ্যই আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে বায়োটেকনোলজি ও বায়োসায়েন্স গবেষণায় যা মানুষকে নিরাপদ রাখবে। সামনের গবেষণায় মূল বিষয় হবে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল এই পৃথিবীর সুরক্ষা।

সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ শিগগির করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সফল হবে, এ প্রত্যাশা রইল। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আমাদের জয় অনিবার্য। কারণ বাঙালির রয়েছে অদম্য সাহস ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় রুখে দেয়ার অফুরান প্রাণশক্তি।

লেখক : প্রফেসর
সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন