জনসংখ্যা বিজ্ঞান যখন অধ্যায়নের বিষয়
প্রকাশিতঃ 8:32 am | December 26, 2019

তিতলি দাস:
মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে সাধারণত মূলধারার বিষয়গুলোর বাইরে পপুলেশন সায়েন্স বা জনসংখ্যা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করা কতটা যৌক্তিক বা সন্তোষজনক তা রীতিমতো শিক্ষার্থীদের কপালে প্রথমে চিন্তার রেখা টেনে দেয়। পপুলেশন সায়েন্স বা জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমিও ব্যতিক্রম না।
বিষয়টি সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে আমি কথা বলেছি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যাওয়া বড়দের সঙ্গে এবং পপুলেশন সায়েন্স থেকে পাস করে বর্তমানে বিভাগের কয়েকজন সম্মানিত শিক্ষকের সঙ্গে।
তাঁদের সঙ্গে কথা বলে যা জানতে পেরেছি তা হলো, শিক্ষাজীবনে তাঁরাও দুশ্চিন্তায় ছিলেন অনেক বেশি। তাঁদের অনেকেই বর্তমানে বিভিন্ন উন্নয়ন খাত তথা ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন এবং অনেকে বর্তমানে পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
তাঁদের ধারণা, আজকের এই অবস্থানে আসার ক্ষেত্রে পপুলেশন সায়েন্স বিশেষভাবে ত্বরান্বিত করেছে।
আমিসহ পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থীদের এই বিষয় সম্পর্কে জানার কৌতুহল এবং গভীর আগ্রহ আমার এ লেখার প্রেরণা। সাবেকদের কাছ থেকে এই বিভাগ সম্পর্কে যা জানতে পেরেছি, তা এরকম-
এক) পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত জনসংখ্যা নিয়ে পরিকল্পনাবিদদের আগ্রহ অন্যান্য বিষয় থেকে একটু বেশি। বিশ্বজুড়ে এই জনসংখ্যা কোন প্রান্তে সমস্যা আবার কোনপ্রান্তে সমাধান বা সুবিধা। সমস্যা এবং সমাধান বা সুবিধার এই বেড়াজালে আবদ্ধ চিন্তাধারার যৌক্তিক বিশ্লেষণই যে পপুলেশন সায়েন্স বিষয়ের মূল চালিকা এতে কোন সন্দেহ নেই। কথাটি আরও স্পষ্ট হয়ে যায় পপুলেশন সায়েন্সের সংজ্ঞা থেকে। যেখানে বলা হয়েছে, পপুলেশন সায়েন্স বা জনসংখ্যা বিজ্ঞান হলো, “বর্তমান সমাজ, অর্থনীতি এবং পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাধান।”
এই সামঞ্জস্যতা কি আর কেনই-বা দরকার?, বিশ্বজুড়ে কেনই-বা জনসংখ্যা নিয়ে এত অস্থিরতা? এতোসব সুগভীর প্রশ্নের কার্যকরী সমাধান পপুলেশন সায়েন্স দিন দিন প্রয়োজনীয়তাকে সুস্পষ্টভাবে অপরিহার্য করে তুলেছে।
পৃথিবীর কোথাও কোথাও জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে, কোথাও-বা নিয়ন্ত্রনে রয়েছে আবার কোথাও-বা কমে যাচ্ছে! কোনো কোনো দেশে তার জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান নেই! কোথাও অঢেল খাবার আবার কোথাও ক্ষুধা বিদ্যমান! কোথাও বিলাসী আবার কোথাও দারিদ্রতা! কোথাও সুষম পরিবেশ আবার কোথাও পরিবেশ বিপর্যয়! এ সবই জনসংখ্যাকে ঘিরে।
এতোসব সমস্যার পাঠগত সমাধান জনসংখ্যা বিজ্ঞান দিলেও বাস্তবতার নিরিখে তার কার্যকারীতা এখনও অনেকটাই পিছিয়ে।
জনসংখ্যা বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত, সেই সময় বাংলাদেশ ‘জনসংখ্যা দেশের বোঝা’ধারণাকে লালন করে চলেছে। যদিও বর্তমান সময়ে পরিস্থিতি অনেকটাই পরিবর্তন হচ্ছে এবং এই পরিবর্তন আগামীতে অটুট থাকবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। অনেকটা দেরীতে ঘুম ভাঙার মতো।
বাংলাদেশ আজ আন্তর্জাতিকভাবে অনেক উন্নয়নমূলক চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা থেকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, দারিদ্র্য বিমোচন নীতিমালা, শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি, পরিবেশনীতি, কতোসব নীতিমালা দেশে তৈরী হচ্ছে যার মূল কেন্দ্রে আছে জনসংখ্যা।
জনসংখ্যাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো এদেশেও আজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পপুলেশন সায়েন্স বা জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগ নামে একটি বিভাগ চালু আছে। বর্তমানে দেশব্যপী মোট তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগ চালু আছে, যা শুরু হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে ঢাকা এবং তারও পরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অচিরেই এই বিভাগ চালু হবে এটাই স্বাভাবিক।
দুই) কি পড়ানো হয় পপুলেশন সায়েন্স বা জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগে?
স্বাভাবিকভাবে যদি প্রশ্ন করা হয় জীবন কি নিয়ে? উত্তর হবে জন্ম, মৃত্যু আর বিয়ে। মজার বিষয় হচ্ছে, পপুলেশন সায়েন্স মূলত এই তিন বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেও এই তিন বিষয়ের মধ্যে যে অভ্যন্তরীণ আরও বিষয় রয়েছে তার সুচিন্তিত এবং কার্যকরী বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটা সময়োপযোগী সিলেবাস রয়েছে। যার বিষয়বস্তু মূলতঃ জনসংখ্যা এবং সমাজ, জনসংখ্যা এবং নৃবিজ্ঞান, জনসংখ্যা এবং অর্থনীতি, জনসংখ্যা এবং পরিবেশ, জনসংখ্যা এবং নগরায়ণ, জনসংখ্যা এবং স্থানান্তর, জনসংখ্যা এবং সম্পদ, জনসংখ্যা এবং পরিবার পরিকল্পনা, জনসংখ্যা অভিক্ষেপ, জীবন সারণীসহ জনসংখ্যা সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়। পাশাপাশি, উক্ত বিষয়গুলোর অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক, সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং বাস্তবতার আলোকে সমাধানের জন্য মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে গবেষণা চলমান।
যেহেতু, গবেষণা এখানে অন্যতম মূল বিষয়, তাই পরিসংখ্যান এবং তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের জন্য বিভিন্ন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিক্ষা এই পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অন্যতম মূল বিষয়।
তিন) কেন পড়বেন পপুলেশন সায়েন্স বা জনসংখ্যা বিজ্ঞান?
এই বিভাগের সাবেকদের মতে এ কথা সহজেই অনুমেয় যে, পপুলেশন সায়েন্স আসলে অনেক বিষয়ের সমন্বয়। সেই সাথে উম্মুক্ত গবেষণার এক অপার সুযোগের মিশ্রণ। যে গবেষণা দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক খাতে নীতি প্রণয়নে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে। এই সুযোগ অন্য যেকোন বিষয়ের থেকে অনেকটাই বেশি।
বর্তমানে দেশে শিক্ষিত বেকার বেড়েই চলেছে। বিষয়ভিত্তিক চাকরির বাজারও সেভাবে গড়ে উঠেনি এখনও। সরকারি চাকরির বাজার বেশ চ্যালেঞ্জিং। বৃহৎ এ শিক্ষিত গোষ্ঠীর অনেকটাই ভরসা হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান; যা কিনা এনজিও সেক্টর নামে পরিচিত। এই এনজিও সেক্টরগুলো দেশের উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি কাজ করছে এবং সেই সাথে সল্পমেয়াদী/দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আর এ উন্নয়ন প্রকল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে জনসংখ্যা বিশেষ করে মহিলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানান্তর, দারিদ্রতা ইত্যাদি যেটা পপুলেশন সায়েন্সের মূল বিষয়বস্তু।
একদিকে, মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা থাকলে এনজিওগুলো একটু বেশিই অগ্রাধিকার দেয়। যেহেতু, পপুলেশন সায়েন্স তার পঠিত বিষয়বস্তু এবং মাঠপর্যায়ে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণার সমন্বয় তাই এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা এক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পাবে এটা জোরালোভাবে বলা যায়।
অন্যদিকে, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বিসিএস হচ্ছে সবার স্বপ্ন। এ ক্ষেত্রে, বড়দের কাছে যা জানতে পেরেছি তা হলো, পপুলেশন সায়েন্স বিষয়টি বিসিএসের বিষয়ভিত্তিক কোডে অন্তর্ভুক্ত করার আলোচনা চলছে। হয়তো অল্প সময়ের মধ্যেই তা হয়ে যাবে। পাশাপাশি, ভাল ফলাফল করে বিদেশে স্কলারশিপের সুযোগও অনেক বেশি এখানে।
তাছাড়া, বিষয়টি কেবলমাত্র তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু থাকলেও নতুন করে চালু করার অপেক্ষায় রয়েছে আরও অনেকগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। তাই, এই বিভাগের ভাল ফলাফলধারী শিক্ষার্থীদের সেইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরির সুযোগ তো থাকছেই।
চার) সবশেষে বিভাগের সাবেকদের কথা ছিল এরকম- প্রতিনিয়ত চাকরির বাজারে নতুন নতুন প্রতিযোগী যোগ হওয়ায় প্রতিযোগিতায় চ্যালেঞ্জ বেড়েছে অনেকগুন। দেখা যাচ্ছে, দুইটি পদের বিপরীতে ত্রিশটি বা তারও বেশি আবেদন জমা পড়ছে। সকলের শিক্ষাগত যোগ্যতাও একই। সুতরাং, দুইজনের মধ্যে কেন আমি, সেটার উত্তর যদি নিজে নিজে তৈরি করতে পারা যায় তাহলে কখনও পিছনে ফিরতে হবে না। আর এই উত্তর তৈরির সকল উপকরণ পপুলেশন সায়েন্স বা জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অর্জন করা সম্ভব। শুধু লক্ষ্যটা নিজেকে ঠিক করতে হবে।
কথায় বলে খাবার, প্লেট আর চামচ রেডি, শুধু আপনাকে কষ্ট করে খেতে হবে। কিভাবে খাবেন তা পপুলেশন সায়েন্স বা জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগ শিখিয়ে দেবে।
শুভকামনা সবার জন্য!
লেখক: শিক্ষার্থী
পপুলেশন সায়েন্স বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।