“অ” সমাচার

প্রকাশিতঃ 10:57 am | December 22, 2019

কে. এম. মুস্তাফিজুর রহমান

ছোটবেলায় পড়েছিলাম, “অ” তে অজগরটি আসছে তেড়ে। একটা অজগরের ছবি আঁকা থাকতো সেখানে যা দেখলেই ভয় লাগতো। এমন কি তখন অনেক বাবা-মা ওই ছড়াটি বাচ্চাদের খাওয়ানোর কৌশল হিসাবেও ব্যবহার করতেন। সে দিনের সেই “অ” তে অজগরের ভয় আজও পিছু ছাড়েনি আমাদের বরং, আরও আশংকাজনক হারে বেড়েছে।

সেদিন তো শুধু “অ” তে অজগরই পড়েছিলাম কিন্তু আজ দেখি “অ” তে আরও ভয়ঙ্কর অনেক কিছুই হয়, যা আমাদের জীবনকে বিষিয়ে তুলছে প্রতিনিয়ত। যেমন ধরুন- অস্বচ্ছতা, অনিয়ম, অনৈতিকতা, অবিচার, অপব্যবহার, অসামাজিকতা, অকার্যকারীতা, অদূরদর্শিতা, অপসংস্কৃতি, অস্থিরতা, অমানুষ এ রকম হাজারও শব্দ আছে যা “অ” দিয়ে শুরু এবং যার নেতিবাচক প্রভাব আমাদের জীবনের সামনের দিনগুলোকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলছে। আমি, আপনি, আমরা সবাই আজ এই নেতিবাচকতার গ্রাসে আবদ্ধ। এবার একটু বিশ্লেষণে যাওয়া যাক-

অস্বচ্ছতাঃ শব্দটি এখন দেশের উন্নয়ন খাতের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে পরিচিত। প্রায় সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এই শব্দটি এমনভাবে জড়িয়ে পড়েছে যে, এটা নিয়ে বিভিন্ন মুখরোচক কাহিনী দেশব্যাপী আলোচিত যার মধ্যে বালিশকাহিনী, পর্দাকাহিনী বিশেষভাবে উল্ল্যেখযোগ্য।

অনিয়মঃ প্রত্যেক উন্নয়নখাত এবং সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে সঠিক দেখভালের অভাবে অনিয়ম শব্দটি প্রায় নিয়মের সমার্থক হিসাবে ব্যবহৃত। প্রসাশন থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য কোন খাতে অনিয়ম নাই, তা বলা রীতিমতো দুষ্কর।

অনৈতিকতাঃ আজ ভাল মানুষের লেবাসে যারা প্রতিনিয়ত নীতির কথা বলছেন তাঁরাই মূলত নীতিহীন ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে প্রশাসনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশ জোরালো ভাবেই সব জায়গায় আলোচিত। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, সময় আর সুযোগের অভাবে তাঁরা নীতির কথা বলেন। আর অপ্রত্যাশিত সত্য হচ্ছে সে সব লেবাসধারীদের কথা মানুষ বিশ্বাসও করে!

অবিচারঃ যাঁরা বিভিন্ন অনাচার বা অত্যাচারের সাথে জড়িত তাঁরা আজ বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করতে বদ্ধপরিকর। বড় বড় বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের বিচার না হওয়া বা বিচারে খুব বেশি দেরী হওয়ায় অবিচার শব্দটা মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত।

অপব্যবহারঃ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অপব্যবহার শব্দটির সাথে আমরা বেশ পরিচিত। আমরা আমাদের প্রতিদিনের অভ্যাসের সাথে অপব্যাবহার শব্দটি সমার্থক শব্দ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছি। সময়, খাবার, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস কোনটার অপব্যবহার আমরা করি না তা চিন্তা করা বেশ কষ্টকর! তবে, বর্তমানে ক্ষমতার অপব্যবহার শব্দটি বেশ প্রচলিত।

অসামাজিকতাঃ বর্তমানে আধুনিকতার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমরা যে অসামাজিক হয়ে পড়ছি তা আজ অস্বীকার করার কোন উপায় নাই। মানবিক মূল্যবোধ, পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ সবই আজ অসামাজিকতার করাল গ্রাসে বন্দী।

অকার্যকারিতাঃ কার্যকর কাঠামো ব্যবস্থার অভাব অকার্যকর শব্দটিকে বর্তমান সমাজে খুব জোরালো ভাবেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। কতশত নিয়ম আছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাপনার জন্য! কিন্তু, নিয়মের প্রয়োগহীনতা বা অপপ্রয়োগই আজ বিভিন্ন খাতে প্রতিনিয়ত অকার্যকারিতার বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে।

অদূরদর্শিতাঃ নচিকেতার একটা গান মনে পড়ে, “আজকে যিনি কয়লামন্ত্রী কালকে তিনি শিক্ষা, তাই কয়লা কালো শিক্ষা নিয়ে মানুষ করে ভিক্ষা!” আসলে দূরদর্শিতার চরম অভাব কেন জানি গানটার সত্যতা নিশ্চিত করে। জীবনের এই অদূরদর্শিতার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবনে।

অপসংস্কৃতিঃ শব্দটি অনেকটা শহুরে হলেও বর্তমানে গ্রাম পর্যায়ে এর পরিচিতি বিদ্যমান। নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল সাংস্কৃতিক ইতিহাস থাকলেও অপসংস্কৃতি সেই ইতিহাসকে মোটামুটি হুমকির সম্মুখীন করেছে। আমাদের চাল-চলন, পোষাক-আশাক, কথা-বার্তা, খাবার-দাবারসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আজ অপসংস্কৃতির বেড়াজালে বন্দী।

অস্থিরতাঃ দৈনন্দিন জীবনের অস্থিরতা আমাদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার স্থিরতা নষ্ট করছে এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। পরিবহণখাতে অস্থিরতা, পোষাকশিল্পে অস্থিরতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা আমাদের চলার পথে প্রতিনিয়ত পরিচিত একটি শব্দ। এসব কিছু ছাড়িয়ে আমাদের দৈনন্দিন বাজারে পণ্যের মূল্য অস্থিরতা আজ আমাদের সকলের প্রতিদিনের পরিচিত একটা শব্দ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

অমানুষঃ মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হলেও বর্তমান সময়ে এই মানুষের মধ্যে হিংস্রতা, নৃশংসতা এতো পরিমানে বেড়েছে যে, আজ তাদের অমানুষ বললেও অনেক কম বলা হয়ে যায়! মানুষের মাঝে পশুবৃত্তি এমনভাবে বেড়েছে যে, খুনীরা খুন করার পরেও খুন হওয়া মানুষটির বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নিয়ে অত্যন্ত সাবলীলভাবে ঘোরাফেরা করতেও নুন্যতম দ্বিধা বোধ করে না!

আসলে “অ” তে সকল অকল্যাণকর শব্দ খুঁজে বের করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয় বরং “অ” কে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটার খোরাক যোগান দেয়াটাই মুখ্য। অস্বীকার করার উপায় নেই, গত এক দশকে দেশ অনেক এগিয়েছে। বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দেশের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, মাথা পিছু আয় বেড়ে চলেছে। বড় বড় প্রকল্প দেশ জুড়ে চলমান। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। কিন্তু, “অ” তে অসাধু কিছু লোকের অকল্যাণকর কিছু কর্মকাণ্ডে এতোসব উন্নয়নের সুফল মানুষ প্রত্যাশিত মাত্রায় ভোগ করতে পারছেন না। বর্তমান সময়ে ক্যাসিনোর সম্রাট থেকে শুরু করে, কুষ্টিয়ার আবরার, সুনামগঞ্জের তুহিন কিংবা বাজারের পেঁয়াজ সবই মানুষরূপী “অ” তে অমানুষের কাজ।

দেশের চলমান অগ্রযাত্রাকে “অ” এর প্রভাবমুক্ত করতে বর্তমান সরকারের ভূমিকা প্রশংসনীয়। যদিও সরকার প্রধানের গৃহীত ভূমিকাগুলো ওই সকল অসাধু ব্যক্তিদের প্রচণ্ড অপছন্দের বিষয়, আর তাতেই তার বাস্তবায়ন এখনও সুষম বেগ অর্জনে প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পোঁছাতে পারছে না।

পরিতাপের বিষয়, সমাজে অসত্য কথা এবং অকাজ আজ বেশী পছন্দের অথচ তা হওয়ার কথা ছিল অপছন্দের। তাই এখন বসে বসে ভাবি, যে জীবনের শুরুটা হয় “অ” তে অজগর দিয়ে সেখানে “অ” এর কালো থাবা থেকে সে জাতির মুক্তি আর যা হোক এতটা সহজ নয়।

তার মানে এটাও নয় যে, কোন ইতিবাচক শব্দ দিয়ে যদি “অ” শুরু হতো তাহলে সবকিছু ভালোভাবে চলতো। বরং নেতিবাচকতাকে ইতিবাচকতায় রূপান্তর করার আন্তরিকতা আমাদের কতখানি তা পরিমাপের বিষয়।

কে.এম.মুস্তাফিজুর রহমান
প্রভাষক,
পপুলেশন সায়েন্স বিভাগ,
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ
ই-মেইলঃ nishan_hrd@yahoo.com

কালের আলো/এমএম/এডিবি