সৌদি থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমানো সম্ভব: গভর্নর

প্রকাশিতঃ 2:43 pm | October 07, 2025

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়া জটিল এবং তুলনামূলক খরচও বেশি। এ খাতে উভয় দেশ যৌথভাবে কাজ করলে অর্থ স্থানান্তরের খরচ কমানো সম্ভব, যা প্রবাসী শ্রমিকদের জন্যও বড় উপকার হবে।

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর বনানীর একটি হোটেলে সৌদি আরব-বাংলাদেশ ব্যবসা সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এই সম্মেলনের আয়োজন করেছে সৌদি আরব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এসএবিসিসিআই)।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং সৌদি আরবের অর্থনীতি একে অপরের পরিপূরক। কারণ—সৌদির প্রয়োজন দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে— বাংলাদেশের জ্বালানি দরকার, সৌদি আরবের রয়েছে বিপুল জ্বালানি সম্পদ। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিনিয়োগ দরকার, সৌদি আরবের রয়েছে বিনিয়োগের সামর্থ্য। এছাড়া বাংলাদেশ টেক্সটাইলসহ অনেক পণ্য রপ্তানি করতে পারে, যা সৌদি আরবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ফলে এটি দুই দেশের জন্যই লাভজনক হতে পারে।

তিনি বলেন, সৌদি আরবের পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ) ভারতে বেশ কয়েকটি বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু এখনও বাংলাদেশে তেমন কিছু করেনি। সৌদি আরবের এই পিআইএফ ও বেসরকারি খাত বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে। সৌদি সরকার ও ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের উদ্যোক্তা ও সম্ভাবনাগুলোকেও কাজে লাগাতে পারে। কারণ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল।

ইসলামী দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবিনিয়োগ এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, বাংলাদেশে প্রবাসী আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস সৌদি আরব, কিন্তু এ অর্থ স্থানান্তরে খরচ বেশি এবং রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়া জটিল। এই খাতে যৌথভাবে কাজ করে অর্থ স্থানান্তরের খরচ কমানো সম্ভব, যা প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য বিশাল স্বস্তি বয়ে আনবে।

বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ইসলামী বিশ্বের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, বৈশ্বিক জনসংখ্যার ২০ শতাংশের বেশি এই অঞ্চলে বাস করে। অর্থনৈতিকভাবে বড় দেশগুলো হলো—তুরস্ক, সৌদি আরব, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়া। ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্ক ইতিমধ্যেই ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি, আর সৌদি আরবও শিগগিরই ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ এখন অর্ধ-ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি এবং ট্রিলিয়নের পথে অগ্রসরমান।

তাই এই অঞ্চলে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত স্থিতিশীল ও গতিশীল—প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৈশ্বিক মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা—কোনো কিছুই দেশের প্রবৃদ্ধিকে নেতিবাচক করতে পারেনি। গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কখনও শূন্যের নিচে যায়নি। সর্বনিম্ন ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে থেকেছে, যা অর্থনীতির স্থিতিস্থাপকতার প্রমাণ দিচ্ছে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে সৌদি বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে গভর্নর বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করুন। স্বল্পমেয়াদি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ নয়, বরং দ্বিপাক্ষিক গ্রিনফিল্ড প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ করুন।

ড. মনসুর বলেন, সৌদি আরবের উচিত বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রসারিত করা, বিশেষ করে তেল ও সারের বাইরে অন্য খাতে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদির সম্পর্ক এখন পর্যন্ত জ্বালানিনির্ভর, কিন্তু এর বাইরেও শিল্প, অবকাঠামো ও প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের বিশাল সুযোগ রয়েছে।

এই সম্মেলন হবে সৌদি আরব ও বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা উন্মোচনের মঞ্চ এমন মন্তব্য করে গভর্নর বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক প্রাচীন ও দৃঢ়। তবে বাণিজ্য, অর্থপ্রবাহ, শ্রমবাজার ও দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করা প্রয়োজন।

অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গড়ে তোলার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিনিই প্রথম সরকারি পর্যায়ে প্রবাসী শ্রমিক পাঠাতে চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক পাঠানো আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে বেসরকারি উদ্যোগে শ্রমিক যেতেন। বর্তমানে সৌদি আরব থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে তা প্রশংসনীয়; তবে যদি দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা যায়, তাহলে রেমিট্যান্স বহুগুণ বাড়বে।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বড় তহবিল প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ লক্ষ্য হলো পুঁজিবাজারকে ‘ফ্রন্টিয়ার ইকোনমি’ থেকে ‘ইমার্জিং মার্কেট’-এ উন্নীত করা। এ ক্ষেত্রে সৌদি তহবিল বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া শুধু জ্বালানি খাত বা বস্ত্র খাতেই নয়, আরও বহু খাতে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন এসএবিসিসিআই সভাপতি আশরাফুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, সৌদি আরব আমাদের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত বন্ধু। তবে দুঃখজনকভাবে গত ৫৩ বছরে দুই দেশের মধ্যে কোনো যৌথ ব্যবসায়ী চেম্বার গড়ে ওঠেনি। অবশেষে আমরা সেটি করতে পেরেছি৷ এখন বাংলাদেশ থেকে বস্ত্র, তৈরি পোশাক, কৃষি পণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, দক্ষ নার্স ও শ্রমিক রপ্তানি বাড়াতে পারি। বিপরীতে বাংলাদেশে অবকাঠামো, সরবরাহ, তথ্যপ্রযুক্তি প্রভৃতি খাতে সৌদি বিনিয়োগ বাড়াতে কাজ করবো।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা তিনটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। একটি প্রবন্ধে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অনেক সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এখনও বাংলাদেশ বা সৌদি আরব কেউই একে অপরের শীর্ষ পাঁচ বাণিজ্য অংশীদারের তালিকায় নেই। বাংলাদেশ বস্ত্র ও পোশাক শিল্প, কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত পণ্য, চামড়া ও জুতা, প্লাস্টিক, ফার্মাসিউটিক্যালস প্রভৃতি পণ্য সৌদি আরবে রপ্তানি করতে পারে। অন্যদিকে, সৌদি আরব খনিজ ও রাসায়নিক পণ্য, এলএনজি, সার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সরবরাহ খাতে রপ্তানি ও বিনিয়োগ বাড়াতে পারে।

দুই দেশের মধ্যে মানবসম্পদ ও দক্ষতা উন্নয়ন আরেকটি বড় ক্ষেত্র উল্লেখ করে মাসরুর রিয়াজ আরও বলেন, বর্তমানে সৌদি আরবে প্রায় ২১ লাখ বাংলাদেশি কর্মরত। তাদের মাত্র ২২ শতাংশ দক্ষ শ্রমিক। সৌদি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এ হার বাড়ানো গেলে বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে মনে করেন তিনি।

কালের আলো/এসএকে