মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: বাতাসে ফুলকুঁড়িদের পোড়া গন্ধে বিষাদের ছায়া

প্রকাশিতঃ 12:21 am | July 23, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:

আচমকা ঝরে পড়েছে একেকটি ফুল। হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে দগ্ধ ও আহত অনেকেই। চোখের সামনেই সন্তানকে পুড়তে দেখেছেন হতভাগ্য মা। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান এফটি-৭ বিজিওয়ান রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের স্কুল ভবনে বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ গেছে ৩১ জনের। নিহত হয়েছেন বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামও। দেশের ইতিহাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা এটিই প্রথম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ট্র্যাজেডির ঘটনাও বিরল। বিভীষিকাময় এই ঘটনায় শোকে মুহ্যমান পুরো দেশ। মাইলস্টোনের বাতাসে এখনও ফুলকুঁড়িদের পোড়া গন্ধ। স্কুলটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাচ্চাদের বই-খাতা, আধপোড়া ব্যাগ, পুড়ে যাওয়া চেয়ার। মাইলস্টোনের ভবনটিতে এখন কেবল ভাঙা ইট, ধুলোর স্তূপ আর একরাশ নীরবতা। অকালেই জীবন থেকে ছুটি নেওয়া কচি প্রাণের এক টুকরো শৈশবের দলিল পোড়া চিঠি’র স্মৃতি পড়ে কাঁদছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সাধারণ মানুষ। কেউ মোবাইল ফোনে সেই চিঠি তুলে রাখছেন যেন ভোলা না যায়।

হাসপাতালে হাসপাতালে পোড়া শরীর নিয়ে শিশুদের বাঁচার আকুতি। আহত সন্তান নিয়ে অভিভাবকদের গগন বিদারী আর্তনাদ। নিহতদের বাড়িতে বাড়িতে কান্না আর আহাজারিতে ভারী সেখানকার পরিবেশ। এখনও ছয়জনের মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার (২১ জুলাই) রাষ্ট্রীয় শোকের মাধ্যমে ঝরে পড়া ফুলদের স্মরণ করেছে সারা দেশ। অর্ধনমিত ছিল জাতীয় পতাকা। দেশজুড়ে ছিল বিষাদের ছায়া। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়ে বলে আগেই জানিয়েছিল আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।

দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে বিমান বাহিনীর পক্ষ থেকে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন তুরস্কে সরকারি সফর বাতিল করে সেখানকার বিমানবন্দর থেকেই এদিন দেশে ফিরে এসেছেন। তিনি বলেছেন, ‘শিগগির তদন্ত কমিটি বের করবে, কী ধরনের ত্রুটি ছিল।’ তিনি দুর্ঘটনার কারণ জানতে সবাইকে ধৈর্য্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন। সরকারের পাশাপাশি বিমানবাহিনীও সবসময় হতাহতদের পাশে থাকবে বলে জানিয়েছেন। আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ও অপতথ্যে কান না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

  • বিভীষিকাময় ঘটনায় শোকে মুহ্যমান পুরো দেশ
  • ছয়জনের মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি
  • পোড়া চিঠি’র স্মৃতি পড়ে কাঁদছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ও অভিভাবকরা
  • ৬ দফা দাবি মেনে নিয়েছে সরকার
  • ৯ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর বের হলেন দুই উপদেষ্টা ও প্রেস সচিব

৬ দফা দাবি মেনে নিয়েছে সরকার, ৯ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর বের হলেন দুই উপদেষ্টা ও প্রেস সচিব
রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিদর্শনে এসে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি. আর. আবরার ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কলেজের দুর্ঘটনাকবলিত হায়দার আলী ভবন পরিদর্শন শেষে বের হওয়ার সময় তাদের পথরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। তারও আগে বেলা পৌনে একটার দিকে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক। সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দিচ্ছি, আমরা প্রতিটা দাবি পূরণ করব। বিশ্বাস রাখেন।’ তবে উপদেষ্টার বক্তব্যের পরও বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকে শিক্ষার্থীরা। এসময় উপদেষ্টারা আবার কলেজের ভেতরে ঢুকে যান। ক্যাম্পাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ সময় অবস্থান করতে দেখা যায়। বিকেলে দীর্ঘ সময় অবরুদ্ধ থাকার পর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে বের হয়ে দিয়াবাড়ি মোড়ে শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে পড়ে আবারও কলেজে ফিরে আসেন আইন উপদেষ্টা, শিক্ষা উপদেষ্টা ও প্রেস সচিব। পৌনে চারটার দিকে উপদেষ্টাদের গাড়ি ঘুরিয়ে আবার তাদের কলেজের ভেতরে একটি ভবনে নেওয়া হয়। শেষতক রাত পৌনে ৮টার দিকে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে ক্ষতবিক্ষত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হন বর্তমান সরকারের এই তিন দায়িত্বশীল।

সরকারের তিন দায়িত্বশীল স্কুলটিতে অবস্থানকালীন সময়েই হতাহতের সঠিক খরব প্রকাশসহ ছয় দফা দাবিতে সকাল শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের দাবি মেনে নেয় সরকার। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে হতাহতদের সংখ্যা লুকানোর অভিযোগ নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, মঙ্গলবার দুপুরে উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। আলোচনা শেষে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, মাইলস্টোন স্কুলে একটি তথ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এতে নিহত ও আহতের তথ্য থাকছে। কেউ নিখোঁজ থাকলে সে তথ্য থাকছে। এখান থেকে তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা হচ্ছে। নিহত ও আহত পরিবারের ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন এবং ট্রমা ম্যানেজমেন্ট সাপোর্টের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

জনগণের ভিড় নিয়ন্ত্রণের সময় সেনাবাহিনীর কর্তব্য পালনকালে কয়েকজন সেনাসদস্য কর্তৃক শিক্ষার্থীদের ওপর মারধরের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে দুঃখপ্রকাশ করা হয়েছে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সেনা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে বলে জানান তিনি।

শিক্ষার্থীদের ৬ দফা দাবিগুলো হচ্ছে- ১. দুর্ঘটনায় নিহতদের সঠিক নাম ও পরিচয় প্রকাশ করতে হবে। ২. আহতদের নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে হবে। ৩. ঘটনাস্থলে শিক্ষকদের গায়ে ‘হাত তোলার’ অভিযোগে নিঃশর্ত প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। ৪. নিহত প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পরিবারকে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৫. বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ বিমান বাতিল করে নতুন ও নিরাপদ প্লেন চালু করতে হবে। ৬. বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ এলাকা মানবিক ও নিরাপদভাবে পুনর্বিন্যাস করতে হবে।

ভবনটিতে মোট কতজন শিক্ষার্থী ছিল নিশ্চিত করতে পারেনি কেউ
বিমানটি যখন মাইলস্টোনের স্কুল শাখার হায়দার আলী অ্যাকাডেমিক ভবনে আছড়ে পড়ে, তখন সেখানে কতজন শিক্ষার্থী ছিল- সে তথ্য এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। শিক্ষা বোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ নিয়ে মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি এ নিয়ে সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারছে না। ওই স্কুলের শিক্ষকরা জানান, ওই ভবনে তৃতীয় থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস হতো। ওই সময় দ্বিতীয় শিফটে অনেক শ্রেণির ক্লাস শেষ হয়েছিল। কিছু শিক্ষার্থীকে তাদের অভিভাবকরা নিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল, কিছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবক একসঙ্গে ছিলেন। অনেকে আবার তখনও শ্রেণিকক্ষে ছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্কুলের জনসংযোগ কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ বলেন, অনেক গণমাধ্যমে কোচিংয়ের জন্য শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছেন এমন বলা হলেও সেটি সঠিক নয়। স্কুল ছুটির সময় ছিল ১টা ৩০ মিনিট। তবে অনেক ক্লাসের শিক্ষকরা একটু আগেই ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে যান। সেসব ক্লাসের শিশুরা ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। আর কিছু ক্লাসে শিক্ষার্থীরা ভেতরে ছিল। তিনি বলেন, যেখানে বিমানটি পড়ে সেখানে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ক্লাসরুম। দুটি ক্লাসে কমপক্ষে ৩০ জন করে ৬০ জন শিক্ষার্থী ছিল। তার মধ্যে অল্প কয়েকজন হয়তো বাইরেও ছিল। তবে ওই ভবনে কতসংখ্যক শিক্ষার্থী ক্লাস করে এ ব্যাপারে ‘সুনির্দিষ্ট’ তথ্য দিতে পারেননি তিনি।

এ বিষয়ে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আমাদের কাছে স্কুলের মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা থাকে। ক্লাস ধরে ধরে তথ্য আমরা পাইনি। ঘটনার পর আমাদের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা জানতে চাওয়া হয়েছে। তারা (মাইলস্টোন) কোনো সাড়া দেয়নি।’ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও বিষয়টি নিয়ে মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের মাধ্যমিক বিভাগের একজন কর্মকর্তা। তবে এখনো সুনির্দিষ্ট তথ্য মেলেনি বলে জানান ওই কর্মকর্তা। এর আগে সকালে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ জনে। তাদের মধ্যে ২৫ জনই শিশু, যাদের বয়স ১২ বছরের নিচে। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও ৭৮ জন। তাদের মধ্যে ৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।

কালের আলো/এমএএইচএন