বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি: নির্বাচনী খেলা কতটা নির্ঝঞ্জাট হবে?
প্রকাশিতঃ 6:41 pm | July 09, 2025

মোস্তফা হোসেইন:
নির্বাচনী পরিবেশ কেমন হবে বাংলাদেশে? রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধরন কেমন হবে ওই সময়? বিশেষ করে রাজনীতির মাঠে প্রায় একচ্ছত্র খেলোয়াড় বিএনপি বনাম জামায়াত ও অন্যান্য দলের মধ্যে খেলা কতটা নির্ঝঞ্জাট হবে? রাজনৈতিক দলগুলোর পথচলায় প্রতিবন্ধকতাগুলো,পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক এবং চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে ইতোমধ্যে কথা-বার্তা হচ্ছে।
সাধারণ একটা ধারণা হচ্ছে- আওয়ামী লীগবিহীনই হবে আগামী নির্বাচন। বিএনপি ছাড়া নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে বেকায়দায় পড়েছিল,আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচনে বিএনপিকে সেই বেকায়দায় পড়তে হবে কিনা এমন প্রশ্নও আসতে শুরু করেছে। এবং এই নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে কীভাবে মূল্যায়ন হবে-তাও ভাবনার বিষয়। কেউ কেউ মনে করছে,অভিযুক্ত নেতাদের বাইরে কেউ কেউ হয়তো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে থাকছে কি না কিংবা সিনিয়র নেতাদের বাদ দিয়ে নতুনদের নিয়ে নির্বাচনী মাঠকে অংশগ্রহণমূলক করার চেষ্টাও কতটা থাকবে সেই আলোচনাও চলছে। বাস্তবতা হচ্ছে-কোনোভাবে যদি আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়াও হয় তারপরও মোটা দাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা থাকতে পারবে,এমন সম্ভাবনা কম।সুযোগ পেলে বড়জোর এটুকু হতে পারে-তারা গোপনীয়তা থেকে প্রকাশ্যে আসার সুযোগ পাবে মাত্র। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এর বেশি কিছু একটা দেবে বলে মনে করার কারণ নেই। সুতরাং বিএনপির সামনে অবারিত মাঠ।
বিএনপিকে তাই অধিক উল্লসিত দেখা যাচ্ছে। তাদের উল্লাসের মাত্রা বোঝা যায় আগামী নির্বাচনে তাদের বিজয়ী আসন আড়াইশ’র বেশি হবে এমন বক্তব্য প্রচার হতে দেখে। কিন্তু এনসিপি নেতা হান্নান মাসউদ তাদের এই আশাবাদের বিপরীতে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার যৌক্তিকতাও নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তার যুক্তি কতটা বাস্তব আর কতটা অবাস্তব তা এখন আমরা অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বিশ্লেষণ করতে পারি। তবে হান্নান মাসউদের বক্তব্য অনুযায়ী বিএনপি ৫০ থেকে ১০০ আসন পেতে পারে এমন অনুমানের ভিত্তি নিয়েও কথা হতে শোনা যায়।
এই মুহূর্তে জনমনে ধারণা হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি বহাল থাকলে ২৫০ আসন পেলো কি পেলো না বড় কথা নয়,সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারে এটাই সর্বাধিক প্রচারিত।তাহলে হান্নান মাসউদের এই তথ্য কেন? তাঁর বক্তব্য বিশ্লেষণকালে আমরা ১৯৯১সালের নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারি। ওই সময় ব্যাপক আলোচনায় আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের নিশ্চয়তা দেখা গিয়েছিল। আওয়ামী লীগের অনেকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনী ফল হলো সরাসরি উল্টো। নির্বাচনে বিএনপি আওয়ামী লীগ থেকে বেশি আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলো।
আব্দুল হান্নান মাসউদ কি এমন কোনো ইঙ্গিত পেয়ে এমন কথা বলেছেন? কিংবা বিএনপিকে হারানোর কোনো অস্বাভাবিক পরিকল্পনা কি লুকিয়ে আছে?তবে এটা নিশ্চিত একক দল হিসেবে এখনও সম্ভাব্য ভোটের হিসেবে বিএনপি অগ্রগামী। এবং যেহেতু বিএনপির প্রতিপক্ষ হিসেবে ধর্মভিত্তিক দলগুলো জোট গঠন প্রক্রিয়া শুরু করেছে,তাই বিএনপি যতটা খালি মাঠ পাওয়ার কথা ততটা তারা পাচ্ছে না। আবার এই মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামী দ্বিতীয় সম্ভাবনার দল হওয়ায় তাদেরও কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। বিএনপিকে মোকাবিলা করতে হবে সম্ভাব্য জোট ও জোট বহির্ভূত দলগুলোকে নিয়ে। আবার জামায়াতে ইসলামীকে মোকাবিলা করতে হবে সম্ভাব্য জোটভুক্ত দলগুলোকেও। সেটা জোটের অভ্যন্তরে হলেও এর রেশ নির্বাচন পরবর্তীকালেও থেকে যাবে এটা নিশ্চিত।
নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপিই শুধু নয় জামায়াতে ইসলামী এনসিপিসহ প্রায় সব দলকেই বিভিন্নমুখী প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হবে। এই মুহূর্তে সংস্কার প্রশ্নে মৌলিক বিষয়ে সামান্যই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো এখনও ঠিক করতে পারেনি কোন বিষয়টি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করবে, কোনটি নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দিতে হবে। এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামীর পরিকল্পনা প্রায় অভিন্ন। কিন্তু ধর্মভিত্তিক অন্য দলগুলোর সঙ্গে সিপিবিরও গরমিল স্পষ্ট।
এনসিপি রংপুর ৪ আসনে দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেনকে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে এখন উত্তরবঙ্গ চষে বেড়াচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীও বিভিন্ন স্থানে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও কর্মীদের নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচনের পথে যে কাঁটাগুলো শক্ত দেয়াল তৈরি করে রেখেছে সেগুলো বহাল রেখে কি নির্বাচন হবে? আর এই চ্যালেঞ্জটুকু একক কোনো দলের নয়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে কীভাবে আমাদের চেনা রাজনৈতিক দলগুলো, এটাই দেখার বিষয়।
জনমত যাচাইয়ের জন্যও ঐক্যবদ্ধ কোনো পরিকল্পনা নেই। এনসিপি চায় তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সংস্কার প্রস্তাবগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই অধিকাংশ সম্পন্ন করুক। যদিও তারা কখনো কখনো মৌলিক কিছু বিষয়ের ঐক্যের কথাও বলে। জামায়াতে ইসলামীও তাদের সুরেই কথা বলছে। এই মুহূর্তে কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারে,শক্তিশালী জনভিত্তি আছে বিএনপির এবং তারাই সর্ববৃহৎ দল তাদের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো সিদ্ধান্ত এখনই গ্রহণ করা ঠিক হবে না। বিএনপিও মনে করে শুধু নির্বাচনের প্রয়োজনে যেসব জরুরি সংস্কার প্রস্তাব আছে সেগুলো নির্বাচনের আগে হোক। বাকিগুলো প্রতিটি দলের ইশতিহারে উল্লেখ থাকবে। কিংবা সেগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব পরবর্তী সংসদের ওপর ন্যস্ত করতে হবে।
এক্ষেত্রে ছোট দলগুলোর অবস্থান স্পষ্টভাবে এর বিপরীত। তাদের হিসাব হচ্ছে-নির্বাচনে তারা যে ভোট পাবে তাতে তাদের পক্ষে সরকার গঠন সম্ভব হবে না। অর্থাৎ আগামী সরকার নিশ্চিতভাবে বিএনপিই গঠন করবে। সুতরাং তাদের স্বার্থ কিংবা তাদের প্রস্তাবসমূহ নির্বাচিত সরকার নয় এখনই বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে-এটা তাদের দাবি। কারণ তারা জানে সংসদ বসলে হয়তো তাদের কোনো প্রতিনিধি সেখানে যাওয়ার যোগ্যতাই অর্জন করবে না। আর যদি করেও তারা বিএনপির তুলনায় সামান্য ভোট পাওয়ার সম্ভাবনাই আছে। এখনই যদি বিএনপিকে জনপ্রিয়তার দিক থেকে ১ নম্বরে স্থান দিতে হয়,তাহলে দ্বিতীয় স্থান লাভকারী দলটির অবস্থান ১৪/১৫তম স্থানেও হবে না। সুতরাং ধরেই নেয়া যায়,বিএনপি যদি ১৫০ পায় সেখানে দ্বিতীয় দলটি পেতে পারে ১৫/২০টি আসন। আর নিম্নকক্ষে যদি ২০টি আসনও কোনো দল বা জোট পায় নিম্নকক্ষের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসনপ্রাপ্তি হবে অতি সামান্য। আর ৩/৪% ভোট পাওয়া দলগুলো ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। তাই সংখ্যানুপাতিক ভোটের দাবিদার দলের সংখ্যাই প্রায় সবাই।
সংখ্যানুপাতিক ভোটের বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত কঠিন হবে।কারণ বিএনপি কিংবা অন্যদলগুলো এই বিষয়ে ছাড় দেবে বলে মনে হয় না। ছোট দলগুলো চাইবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে তাদের দাবিই প্রতিষ্ঠিত হোক। বিএনপি এই বিষয়ে স্পষ্ট মত দিয়ে রেখেছে। তাদের কথা নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচিত হবে। এই মুহূর্তে দুটি পক্ষের অবস্থান এতটাই কট্টর যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের স্বপ্নও ভেস্তে যায় কি না তা বলা যাচ্ছে না। আর বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে দ্বিমত রেখে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
সংবিধান বিষয়েও কিন্তু ঐকমত্য হয়নি।সংবিধান সংশোধন কিংবা পুনর্লিখন বিষয়টি অনালোচিত রয়ে গেছে। বিএনপি বলছে এখন দিকনির্দেশনা থাকতে পারে। সংশোধন করবে পরবর্তী সংসদ। কিন্তু এনসিপি ও কয়েকটি ছোট দল চাইছে নতুন সংবিধান রচনা। দীর্ঘদিন ধরেই এই বিতর্ক চলছে। কেউ কাউকে এক ইঞ্চিও ছাড় দিতে রাজি নয়।
এদিকে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে নিম্নকক্ষের সদস্য নির্বাচন বিষয়েও প্রস্তাব আসছে। অর্থাৎ ভোটের পদ্ধতি নিয়েও দ্বিমত স্পষ্ট।উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ দুটোই যদি প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে হয় তাহলে বিএনপির মতো বড় দলটিকে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। বিএনপি সেটা মেনে নেবে কেন? অন্যদিকে নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের হার অনুযায়ী যদি উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচিত হয় সেখানে বিতর্ক থাকবে-ভোটাররা যে দলকে অনুপযুক্ত মনে করে ভোট দেয়নি সেও সদস্য হয়ে যাবে। তাইলে গণতন্ত্রের মূল্য থাকে কোথায়। এমনও হতে পারে কেউ হয়তো নিম্নকক্ষের নির্বাচনে হেরে গেলো কিন্তু সেই পরাজিত প্রার্থীই উচ্চকক্ষের সদস্য হয়ে গেলো।
অন্যদিকে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি অবলম্বন করলে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভাগ্য কী হবে? এখনও যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হয় স্বতন্ত্র প্রার্থীই নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারেন। নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত ভোটের হার অনুযায়ী যদি উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচিত হয় তাহলে স্বতন্ত্রদের অবস্থা কী হবে? যতদূর মনে আসে এই পর্যন্ত বিষয়টি আলোচনায় আসেনি।
নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই নিশ্চিত হতে হবে সংরক্ষিত নারী আসন বিষয়টিও। সংস্কার প্রস্তাব এসেছে তিনটি আসনে নারী প্রার্থীরা সরাসরি নির্বাচন করবেন। অবাস্তব প্রস্তাব বলে কেউ কেউ সমালোচনা করেছেন এটিকে। বর্তমান পদ্ধতি অব্যাহত রেখেই নারী আসন সংখ্যা বাড়ানোর দাবি বিএনপির। কিন্তু সেই বিষয়টিও এখনও সুরাহা হয়নি।
সংবিধান সংশোধনে গণভোটের প্রস্তাব বিষয়টি কিছুটা ঝিমিয়ে পড়লেও বাতিল হয়নি এখনও।প্রশ্ন থেকে যাবে সংস্কার কমিশনের সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়ন হবে কীভাবে? নব্বুইয়ের দশকে যেভাবে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী সরকার পদ্ধতিসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়েছিল তেমন হবে কি? এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকালে তিন দলীয় জোটের রূপরেখা পরবর্তী সরকারগুলো বাস্তবায়ন করেনি,অথচ তারা সর্বসম্মত হয়েই রূপরেখা তৈরি করেছিল। যে কারণে ছো্ট দলগুলো চাইছে সংস্কার কমিশনের মাধ্যমেই সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন হোক।বিএনপি আইনানুগ পদ্ধতি হিসেবে সংসদের ওপর বিষয়টি ছেড়ে দিতে চায়।তাহলে এক্ষেত্রেও জটিলতা থেকেই যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতেও এনসিপি রংপুর ৪ আসনে দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেনকে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে এখন উত্তরবঙ্গ চষে বেড়াচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীও বিভিন্ন স্থানে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও কর্মীদের নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে নির্বাচনের পথে যে কাঁটাগুলো শক্ত দেয়াল তৈরি করে রেখেছে সেগুলো বহাল রেখে কি নির্বাচন হবে? আর এই চ্যালেঞ্জটুকু একক কোনো দলের নয়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে কীভাবে আমাদের চেনা রাজনৈতিক দলগুলো, এটাই দেখার বিষয়।
লেখক : সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।