বেড়েছে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন
প্রকাশিতঃ 12:33 pm | July 09, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
সারা দেশে নারী ও কন্যাশিশুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ, হত্যা, শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছে নারী ও কন্যাশিশু। মঙ্গলবার (০৮ জুলাই) বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ১৫টি পত্রিকার খবর সংকলন করে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে তাঁরা বলেছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৫২৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছিল সংবাদমাধ্যমে। এর মধ্যে ৫১৬টি ছিল ধর্ষণের ঘটনা। শিশু ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৩৬৭টি। তবে এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৪৮১ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে শিশু ৩৪৫টি।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক বছরের তুলনায় এই বছরের প্রথম ছয় মাসেই ধর্ষণের খবর মাত্র ৩৫টি কম। এ ছাড়া নারীর প্রতি সহিংসতার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনাই সবচেয়ে বেশি। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নিজ কার্যালয়ে আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তনে ‘নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার চিত্র: নারী সাংবাদিকদের ভাবনা’ শিরোনামে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কোমর সোজা করে দাঁড়াতে না পারায় নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা ধারাবাহিকভাবে ঘটছে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছেন তাঁরা। অন্যদিকে, মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্য বলছে, গত জুন মাসে ৩৬৩টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৬৩টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণ ও হত্যা চারটি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে সাতজন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারী। জুনে ২১ জন কিশোরী, ২৬ জন নারীসহ মোট ৩৫ জন আত্মহত্যা করেছে।
‘নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার চিত্র: নারী সাংবাদিকদের ভাবনা’ শিরোনামে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানায়, গত ছয় মাসে ১ হাজার ৫৫৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০৬ জন। এর মধ্যে ১৭ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। সহিংসতার মধ্যে ধর্ষণের পর সবচেয়ে বেশি খবর প্রকাশিত হয়েছে হত্যার। প্রকাশিত খবর অনুসারে, ৩২০ জন নারী ও কন্যা হত্যার শিকার হয়েছেন। ৫১ জন যৌন নিপীড়ন ও ৩৪ জন উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন। গত বছর ৫২৮ নারী ও কন্যাকে হত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া ১৮১ জন যৌন নিপীড়ন ও ৪৩ জন উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছিলেন। রহস্যজনক মৃত্যু, আত্মহত্যা, শারীরিক নির্যাতন, সাইবার ক্রাইম, যৌতুকের কারণে নির্যাতন ও হত্যার খবর প্রকাশের আধিক্যও ছিল।
সভায় দুটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের বিশেষ প্রতিনিধি ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের গণমাধ্যম উপপরিষদের সদস্য মুনিমা সুলতানা ও সংগঠনের জ্যেষ্ঠ প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কর্মকর্তা আফরুজা আরমান। প্রতিবেদন দুটিতে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র ও সাংবাদিকদের জন্য করণীয় তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, সমাজের অভ্যন্তরে থাকা নারীর প্রতি বৈষম্যকে দৃশ্যমান করা, নারীর কণ্ঠকে গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ তৈরি, প্রকাশিত সংবাদের মধ্য দিয়ে সবাইকে সচেতন করে তোলা, আইনি সহায়তা পেতে সহায়তা করা এবং সহিংসতার বিপরীতে নারীর জীবনসংগ্রামে জয়ী হওয়ার গল্প তুলে ধরার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকেরা সহিংসতার বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করেন। এ ভূমিকা আরও জোরেশোরে পালন করতে হবে।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, এখন ‘মব ভায়োলেন্স (উচ্ছৃঙ্খল জনতার সংঘবদ্ধ সহিংসতা)’ দিয়ে আইন নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সমাজকে নারীবিদ্বেষী করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। সমাজে আগেও নারীবিদ্বেষ ছিল। তবে সেটিকে আরও উসকে দেওয়া হচ্ছে। বিচার চাওয়ার জায়গায়ও বাধা তৈরি করা হচ্ছে অভিযোগ করে ফওজিয়া মোসলেম বলেন, আইনগত সহায়তা প্রদান আইন সংশোধন করা হয়েছে। এই আইন সংশোধনের ফলে যৌতুকের কারণে সাধারণ জখমের শিকার নারীদের লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে মামলাপূর্ব বাধ্যতামূলক মধ্যস্থতায় যেতে হবে। তিনি আরও বলেন, যার যার জায়গা থেকে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদ করতে হবে। সবাই মিলে সোচ্চার হলে পরিবর্তন আসবেই।
সভায় সূচনা বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, সংবাদমাধ্যমে সহিংসতার অনেক খবর স্থান পায় না। প্রকৃত ঘটনা আরও বেশি। এখন আরও নতুন নতুন ধরন ও মাত্রা নিয়ে নারী নির্যাতন হচ্ছে। সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সহিংসতার ঘটনাগুলোকে রাজনৈতিক দৃষ্টি দিয়ে দেখা হচ্ছে। নির্যাতনের আসল ঘটনা ছাপিয়ে রাজনীতিই সেখানে বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) বার্তা সম্পাদক এবং সংগঠনের প্রচার ও গণমাধ্যম সম্পাদক মাহফুজা জেসমিনের সঞ্চালনায় সভায় সাংবাদিকদের মধ্যে বক্তব্য দেন শাহনাজ মুন্নী, নাদিরা কিরণ, রীতা ভৌমিক, উম্মুল ওয়ারা সুইটি, জাহিদা পারভেজ, শাহনাজ পারভীন, সেবিকা দেবনাথ, দ্রোহী তারা, রাফিয়া খানম চৌধুরী, জান্নাতুল রুহি, নাসরিন গীতি, সেলিনা আক্তার।
সাংবাদিকদের বক্তব্যে বাসে, পথে চলাচলে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের হয়রানির শিকার হওয়া, নারী সাংবাদিকদের চাকরির জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়া, সংবাদমাধ্যমে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের না থাকা, নারীদের প্রতি সহিংসতার খবর অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করার প্রবণতা ইত্যাদি উঠে আসে। এ ছাড়া সভায় নারী নির্যাতনের অবনতিশীল পরিস্থিতি প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা, সবার সম্মিলিত আওয়াজ তোলা এবং গণমাধ্যমকে আরও শক্তিশালী ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
কালের আলো/এমএএইচএন