ঘুরে দাঁড়িয়েছে খুলনা শিপইয়ার্ড, ভূরাজনৈতিক প্রয়োজনে শক্তিশালী নৌবাহিনীর ভূমিকার গুরুত্ব নৌবাহিনী প্রধানের
প্রকাশিতঃ 10:32 pm | June 26, 2025

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
এক সময় দেনার দায়ে ধুঁকছিল খুলনা শিপইয়ার্ড। প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রমের সেই অবস্থা থেকে দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দক্ষ ব্যবস্থাপনায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তৈরি করেছে যুদ্ধজাহাজ। প্রতিষ্ঠানটির সাফল্যের টুপিতে এবার যুক্ত হলো আরও নতুন পালক। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আধুনিকায়ন ও ত্রিমাত্রিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে দেশীয় প্রযুক্তিতে এবার তাঁরা নির্মাণ করেছে তিনটি ডাইভিং বোট পানকৌড়ি, গাংচিল ও মাছরাঙ্গা। ডুবুরি কার্যক্রমের আধুনিকায়নে বোট তিনটিতে রয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। এসব ডাইভিং বোটগুলোর প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৩৮ দশমিক ৯০ মিটার এবং প্রস্থ ৯ মিটার। বোটগুলো ঘন্টার সর্বোচ্চ ১৫ নটিক্যাল মাইল বেগে চলতে সক্ষম।
বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) সকালে খুলনার নেভাল বার্থে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এই তিনটি ডাইভিং বোটের কমিশনিং করেন নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান। তিনি বোটগুলোর অধিনায়কদের হাতে কমিশনিং ফরমান তুলে দেন। পরে নৌবাহিনীর রীতি অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে নামফলক উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠানে নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সর্বোপরি ভূরাজনৈতিক প্রয়োজনে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য বলে মনে করেন।
আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, নিজস্ব সক্ষমতায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী আধুনিক যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ ও সরঞ্জামাদি তৈরির মাধ্যমে নৌবহরকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১০ জুন খুলনা শিপইয়ার্ডে কিল লেয়িং এর মাধ্যমে দেশীয় প্রযুক্তিতে তিনটি ডাইভিং বোট নির্মাণ কাজ শুরু হয়। নির্মাণ কাজ ও প্রয়োজনীয় টেস্ট ট্রায়াল শেষে চলতি বছরের ৬ মে ডাইভিং বোটগুলো বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এদিন লম্বা সাইরেন ও ঘণ্টা বাজিয়ে জাহাজ তিনটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। প্রতিটি বোটে রয়েছে ১২.৭ মিলিমিটার হেভি মেশিন গান, উন্নত সার্ভেইল্যান্স র্যাডার, জিপিএস, ইকো-সাউন্ডার ও আধুনিক কন্ট্রোল সিস্টেম। ডাইভিং বোটগুলোতে শান্তিকালীন সামুদ্রিক নিরাপত্তা প্রদানসহ ডাইভিং অপারেশন, উদ্ধার অভিযান পরিচালনা, স্যালভেজ অপারেশন, দুর্যোগ ও ত্রাণ তৎপরতায় অংশগ্রহণ, সমুদ্র এলাকায় আইন শৃঙ্খলারক্ষাসহ বিভিন্ন কনস্টাবুলারি দায়িত্ব পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ডাইভিং কার্যক্রমে ব্যবহৃত আধুনিক সরঞ্জাম ও সেন্সরে সুসজ্জিত এই বোটগুলোর মাধ্যমে নৌবাহিনীর ডুবুরিরা আরও কার্যকর ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্বপালনে সক্ষম হবে।
ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তরের পর বদলে যায় দৃশ্যপট
জানা যায়, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তৎকালীন পাকিস্তান ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (পিআইডিসি) খুলনায় একটি শিপইয়ার্ড নির্মাণের জন্য পশ্চিম জার্মানির মেসার্স স্টাকেন শন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করে। ১৯৫৪ সালে নির্মাণকাজ শুরুর পর প্রতিষ্ঠানটি ১৯৫৭ সালের ২৩ নভেম্বর থেকে উৎপাদনে যায়। সে সময় রূপসা নদীর প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা ও গভীরতাকে বিবেচনায় রেখে সর্বোচ্চ ৭০০ টন লাইট ওয়েট বা আড়াই হাজার টন কার্গো ধারণসম্পন্ন জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের সুযোগ-সুবিধাসহ এটি নির্মিত হয়। উৎপাদনের শুরু থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা এবং পরে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত জার্মান এবং ব্রিটিশ ব্যবস্থাপনায় শিপইয়ার্ডের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
এরপর একই বছর ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (ইপিআইডিসি) প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। আর স্বাধীনতার পর এটি পরিচালনার দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ স্টিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (বিএসইসি)। প্রথম দিকে মোটামুটি সফলভাবে পরিচালিত হলেও আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রতিষ্ঠানটির সফলতার হার নিম্নগামী হতে থাকে। নব্বই দশকে এসে যা লোকসানের ভারে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এমন অবস্থায় তৎকালীন বিএনপি সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে রুগ্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করে। পরে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নৌবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
খুলনা শিপইয়ার্ডের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটা বেশ চমকপ্রদ। ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকা ৬৮ বছরের পুরোনো এই প্রতিষ্ঠান ঘোষিত হয়েছিল রুগ্ন শিল্প হিসেবে। দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৯৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। কিন্তু এখন সেই দুরবস্থা আর নেই। ১৯৯৯ সালের ৩ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে। ২০০৮ সালের মধ্যেই দেনা শোধ, এরপর থেকে লাভজনক হয়ে ওঠা। খুলনা শিপইয়ার্ড ২০১০ সালে নৌবাহিনীর জন্য তৈরি শুরু করে পাঁচটি যুদ্ধজাহাজ। ২০১৩ সালে দেশের তৈরি প্রথম যুদ্ধজাহাজ হস্তান্তর করা হয় নৌবাহিনীকে। সেখানে তৈরি হয়েছে কনটেইনারবাহী জাহাজ।
দেখা গেছে, খুলনার অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান যখন একে একে বন্ধ হয়ে গেছে ওই সময় খুলনা শিপইয়ার্ডের উত্তরোত্তর এমন সমৃদ্ধি ব্যতিক্রম। নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেওয়ার পর সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকের নিরলস প্রচেষ্টাতেই মিলেছে এমন সাফল্য। বর্তমানে কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ সবকিছুই এই প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে মেটানো হচ্ছে।
নৌবাহিনী আজ একটি পুর্ণাঙ্গ ও ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে পরিণত হয়েছে
খুলনার নেভাল বার্থে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে এই তিনটি ডাইভিং বোটের কমিশনিং প্রদান অনুষ্ঠানে নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান বলেন, ‘বিশাল সমুদ্র অঞ্চলের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে, যুদ্ধ ও শান্তিকালীন বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং উদ্ধার অভিযানে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনতা লাভের পর একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠনের লক্ষ্যে অল্পকিছু অকুতোভয় নৌ সদস্যকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী আজ একটি পুর্ণাঙ্গ ও ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনীতে পরিণত হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশাল সমুদ্র এলাকার সার্বভৌমত্বরক্ষা এবং ব্লু-ইকোনমি সংক্রান্ত কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে নৌবাহিনীর কর্মপরিধি ও দায়িত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে নৌবাহিনী আজ আন্তর্জাতিক পরিমলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে চলেছে। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে খুলনা শিপইয়ার্ডে নির্মিত তিনটি ডুবুরি জাহাজ নৌবাহিনীতে কমিশনিং করতে পেরে আমি আনন্দিত। এর মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতার পথে আরও এক ধাপ এগিয়েছে নৌবাহিনী।’
অনুষ্ঠানে খুলনা নৌ অঞ্চলের কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল গোলাম সাদেকসহ সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, জাহাজের কর্মকর্তা ও নাবিকরা উপস্থিত ছিলেন।
কালের আলো/এমএএএমকে