বজ্রপাতে বাড়ছে মৃত্যু
প্রকাশিতঃ 10:45 am | May 18, 2025

কালের আলো রিপোর্ট:
মাদারীপুরের টেকেরহাটের চরগোবিন্দপুর এলাকার ইটভাটার কাঁচা ইট সংরক্ষণ করছিলেন খুলনার কাজল মোল্লা। শনিবার (১৭ মে) বজ্রপাতে মৃত্যু হয় তাঁর। একই দিনে ঘটমাঝি ইউনিয়নের কুন্তিপাড়া ও রাজৈর উপজেলার পাইকপাড়ায় বজ্রপাতে আরও দু’জন মারা গেছেন। শুধু কাজলই নন, এদিন সারা দেশে পৃথক বজ্রপাতের ঘটনায় মোট ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে কুড়িগ্রামের চিলমারী ও উলিপুরে দুই গৃহবধূ, কিশোরগঞ্জের ইটনায় কৃষক, ফরিদপুরের ভাঙ্গায় স্কুলছাত্র, টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে শিশু, শেরপুরের শ্রীবরদীতে শ্রমিক ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে এক কৃষক রয়েছেন।
দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাতে প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। দেশের বজ্রপাত পরিস্থিতি এবং হতাহতের ঘটনা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরাম। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে বজ্রপাতে প্রাণ গেছে ৪ হাজার ১৫৮ জনের। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২৯৭ জন বজ্রপাতে মারা গেছেন। এর মধ্যে ২০২১ সালে সর্বোচ্চ ৩৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই কৃষক, জেলে শ্রেণির নিম্নআয়ের মানুষ। আবার বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটছে কৃষিক্ষেত ও হাওর এলাকায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বায়ুদূষণ। সাধারণত এপ্রিল- মে মাসে বজ্রপাতে মৃত্যু ঘটছে বেশি। অন্যদিকে, বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বজ্রপাতে মৃতদের বেশিরভাগই হন কৃষক, গৃহবধূ, শ্রমিক এবং স্কুল-কলেজগামী শিশু-কিশোররা।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের (এসএমআরসি) তথ্যমতে, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বজ্রপাতের সংখ্যা ও এতে প্রাণহানির দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষ ঝুঁকিতে রয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বাংলাদেশে অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞরা জানান, বছরে বজ্রপাতে গড়ে ২৫০ থেকে ৩৫০ জন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা ২৮৮। আর ২০২৫ সালের শুরু থেকেই যেন আরও ভয়াল হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি। মাত্র জানুয়ারি থেকে মে মাসের প্রথম দশকে দেশজুড়ে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, খোলা স্থানে কাজ করা মানুষ বজ্রপাতে বেশি মারা যাচ্ছে; বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে খোলা জায়গায় মানুষজন কাজ করার কারণে সেখানে হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটছে। এ ছাড়া গত কয়েক দশকে বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। ফলে এবার তাপ বেশি হওয়ার কারণে বজ্রপাত হচ্ছে অনেক। একই সঙ্গে বর্ষাকালের দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় বজ্রপাত বেশি হবে। অন্যদিকে বজ্র প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, ‘কিশোরগঞ্জ হাওর অধ্যুষিত। ১৫ থেকে ২০ বছর আগেও আমাদের কিশোরগঞ্জে যে পরিমাণ গাছপালা ছিল, তা এখন আর নেই। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে এবং তাপমাত্রা বেড়েছে। বজ্রপাত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এটি। সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের উচিত ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করা। প্রশাসনের প্রতি আবেদন থাকবে, বেশি করে বজ্র নিরোধক যন্ত্র যেন স্থাপন করা হয়। বেশি বেশি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সতর্কবার্তা প্রচার করতে হবে। খোলা জায়গায় অবস্থান এড়াতে হবে।’
দুর্যোগবিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, বজ্রপাতে মৃত ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশই কৃষক, জেলেসহ নিম্নআয়ের মানুষ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করলেও সরকার এখন পর্যন্ত আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে আলাদা কোনো তহবিল গঠন করেনি।
বাংলাদেশে বজ্রপাতের ঘটনা বৃদ্ধির সঙ্গে বায়ুদূষণের সম্পর্ক নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, নির্দিষ্ট কিছু বায়ুদূষণকারী উপাদান; বিশেষ করে ধূলিকণা ও সালফেট বজ্রপাতের হার বৃদ্ধির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বজ্রপাতসংক্রান্ত উল্লিখিত গবেষণার জন্য ৬ বছরে বাংলাদেশে ৮০ লাখের বেশি বজ্রপাতের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ৫ এপ্রিল এক দিনেই ৮ লাখের বেশি বজ্রপাত ঘটেছে।
‘রোল অব পলিউট্যান্টস অন দ্য বাইমোডাল লাইটনিং ডিস্ট্রিবিউশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, এপ্রিল থেকে মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের দিক থেকে প্রবাহিত শক্তিশালী পশ্চিমা বাতাস বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে ধূলিকণা ও সালফেট নিয়ে আসে। এ উপাদানগুলো মেঘের গঠনে প্রভাব ফেলে এবং বজ্রপাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে। তাই এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়কাল দেশে বজ্রপাত খুব বেশি থাকে। এ সময়টিকে বলা হচ্ছে বজ্রপাতের ‘শীর্ষ শিখর’। বজ্রপাতের ‘দ্বিতীয় শিখর’ হলো আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর। অন্যদিকে শীতকালে বায়ুমণ্ডলে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা অর্থাৎ পিএম ২.৫ এর ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়, যা সূর্যালোক বাধাগ্রস্ত করে। এতে বজ্রপাতের সম্ভাবনা কমে আসে। তাই ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে সবচেয়ে কম বজ্রপাত ঘটে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. ফারুক হোসাইন বলেন, বজ্রপাত বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে জলবায়ু পরিবর্তন। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বায়ুমণ্ডলে আর্দ্রতা ও উষ্ণ বায়ুর মিশ্রণ বেড়েছে। ফলে এই পরিস্থিতি বজ্রমেঘ তৈরির উপযোগী আবহাওয়া সৃষ্টি করছে বারবার। এছাড়া বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এখানে মৌসুমি জলবায়ু, উচ্চ তাপমাত্রা ও ঘন মেঘ তৈরি হয়। ফলে এ আবহাওয়া বজ্রপাতের জন্য একটি প্রাকৃতিক ‘হটস্পট’ তৈরি করেছে।
ঘন ঘন বজ্রপাত হতে থাকলে কোনো অবস্থায়ই খোলা বা উঁচু জায়গায় না থাকাই ভালো। সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোনো দালানের নিচে আশ্রয় নেওয়া যায়। উঁচু গাছপালা ও বিদ্যুতের লাইন থেকে দূরে থাকতে হবে। খোলা জায়গায় অনেকে একত্রে থাকার সময় বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে সরে যেতে হবে। বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি থাকা যাবে না। জানালা বন্ধ রাখতে হবে। ঘরের ভেতর থাকতে হবে।
ধাতব বস্তু এড়িয়ে চলতে হবে। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা যাবে না। এমনকি ল্যান্ডলাইনের টেলিফোনও স্পর্শ করা যাবে না। টিভি, ফ্রিজ ইত্যাদি বন্ধ করা থাকলেও ধরা যাবে না। বজ্রপাতের আভাস পেলে আগেই এগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। বজ্রপাতের সময় রাস্তায় গাড়িতে থাকলে যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে ফেরার চেষ্টা করতে হবে কিংবা গাড়ি কংক্রিটের ছাউনিযুক্ত কোনো নিরাপদ জায়গায় নিতে হবে।
বজ্রপাত অব্যাহত থাকলে সে সময় রাস্তায় বের না হওয়াই মঙ্গল। এ সময় বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে, উপরন্তু কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়লে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। কালো মেঘ দেখা দিলে নদী, পুকুর, ডোবা, জলাশয় থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখতে হবে। খোলা মাঠে থাকলেও পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়তে হবে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান বলেন, বজ্রঝড় সাধারণত খুব দ্রুত তৈরি হয়, তাই আগাম সতর্কতা না থাকলে মাঠে কাজ করা কৃষকদের পক্ষে সময়মতো নিরাপদ আশ্রয় নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তবে খুব শিগগিরই বজ্রপাত হতে পারে পরিবেশে এমন কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন, আকাশে হঠাৎ ঘন মেঘ জমা হওয়া, মেঘের গর্জন, বাতাসের আচরণে দ্রুত পরিবর্তন, ঝোড়ো হাওয়া ও বিদ্যুৎ চমক দেখা দিলে বুঝতে হবে বজ্রপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এসব লক্ষণ দেখা দিলেই খোলা মাঠ, ধানক্ষেত বা জলাশয় ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়া উচিত। কৃষকদের মধ্যে এসব লক্ষণ চেনার প্রশিক্ষণ ও মোবাইল ফোনে বার্তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা গেলেও মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কালের আলো/আরআই/এমএসএএকে