স্বাধীনতা দিবস এবং দেশগড়ার দৃপ্ত শপথ
প্রকাশিতঃ 10:21 am | March 26, 2022

ড. মতিউর রহমান:
১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসকরা হিন্দু—মুসলিম দ্বি–জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে দুভাগ করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি আলাদা রাষ্ট্র সৃষ্টি করে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিস্তর দূরত্ব ও পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও শুধু ধমীর্য় পরিচয়ের ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ববঙ্গ নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। কিন্তু সৃষ্টির অল্পকাল পর থেকেই পূর্ব বঙ্গের বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের অবহেলা আর সর্বক্ষেত্রে চরম বৈষম্য ও বঞ্চনা বাঙালিদের ক্ষুব্ধ করে তোলে।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কেবল অর্থনৈতিক শোষণই নয়—বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপরও নিপীড়ন শুরু করে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। তখনই থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে।
স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য অপরিসীম। এই দিনটি আমাদের জন্য একই সঙ্গে আনন্দ—বেদনার অনুভূতি জাগায়। একদিকে স্বজন হারানোর কষ্ট অন্যদিকে প্রাপ্তির আনন্দ। তবে শেষ পর্যন্ত সর্বস্ব হারিয়েও স্বাধীনতা প্রাপ্তির অপার আনন্দই বড় হয়ে ওঠে প্রতিটি বাঙালির কাছে। গৌরবোজ্জ্বল এই দিনটি প্রতি বছর আমাদেরকে আত্মত্যাগ ও আত্মপরিচয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং সেই সাথে মনে করিয়ে দেয় দেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
ইতিহাসবিদদের মতে, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনা গড়ে উঠেছিল সেই ১৯৪৭ সালেই। পরবর্তীতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ক্রমাগত শোষণ, নিপীড়ন, বৈষম্যমূলক আচরণ, ন্যায্য অধিকার প্রদানে অস্বীকৃতি প্রভৃতি এই চেতনাকে বেগবান করে। স্বাধিকার অর্জনের এই চেতনা ও আকাঙ্খা ১৯৭১ এ এসে বাস্তব হয়ে ওঠে। আর এই চেতনা ও স্বাধীকার অর্জনের অন্যতম রূপকার ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৫২ সালে উর্দুকে আবারও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে পূর্ববঙ্গের ছাত্রজনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে। বর্বর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মিছিলে গুলি চালালে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ আরও অনেকে নিহত হন। নিহতদের শহিদের মর্যাদা দেওয়া হয়। শহিদদের এই পবিত্র রক্তই বাঙালির হৃদয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের চেতনা তৈরি করে। তারা বুকের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনে প্রত্যয়দীপ্ত শপথ গ্রহণ করে।
১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবিতে নড়বড়ে হয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার ভিত। ১৯৫৫ সালে পূর্ববঙ্গের নামকরন করা হয় পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৫৬ সালে আবারো সরকারি ভাষা নিয়ে বিতর্ক, আইয়ুব খানের অপশাসন, পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঋণ বাঙালিদের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া প্রভৃতি কারণে বাঙালিদের মনের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে। পাকিস্তান সরকার এক দেশ দুই অর্থনীতি চালু করে।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ক্রমাগত বৈষম্য, শোষণ ও বঞ্চনার প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের লাহোরে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন চেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা পেশ করেন। ৬ দফা ছিল বাঙালির ‘মুক্তির সনদ’। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পেরেছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ভাষা, সংস্কৃতির প্রতি আঘাত আর রাজনৈতিক দমন পীড়নের জবাব হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ছিল স্বাধিকার আন্দোলনের দলিল। স্বায়ত্ত্বশাসন থেকে স্বাধীনতার দলিল হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার জনপ্রিয়তায় আইয়ূব খান ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ নামে একটি রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করে তাকে সহ আরো অনেককে গ্রেফতার করে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
গণবিক্ষোভ প্রতিহত করতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সামরিক শাসনের মাধ্যমে স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর চালাতে থাকে অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতন। কিন্তু প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেয়। এমনকি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনকে ঘিরে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা নতুন দিনের সোনালী সূর্যের আশায় দিন গুনতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির জাতীয় চেতনাবোধ এতোই বৃদ্ধি পায় যে পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে তারা নির্বাচনে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এর বিশাল বিজয় এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির ভরাডুবিতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভীষণভাবে শঙ্কিত হয়। এজন্য ক্ষমতা হস্তান্তরে তারা নানা প্রতারণার আশ্রয় নেয়।
১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৭০ এর নিবার্চনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। সংলাপের নামে কালক্ষেপণ করে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর নির্বিচারে গণহত্যা চালালে অদম্য বাঙালি জাতি গণহত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ফলে শুরু হয় বাঙালির একদফার আন্দোলন— স্বাধীনতার আন্দোলন।
এর আগে ১৯৭১ এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক এক ভাষণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে যুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তত থাকার নির্দেশনা প্রদান করেন যা প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা বলে ঐতিহাসিকেরা উল্লেখ করেন। ২৫ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সংগঠকবৃন্দ অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার গঠন করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, বন্ধুরাষ্ট্রসমূহের সর্বাত্মক সহায়তা, বিশ্ব গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত করে।
বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য দূরীকরণে তথা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা অপরিসীম এবং অনস্বীকার্য। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, শোষণ, নির্যাতন ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির মহামাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে। কেবল তাই নয়, তাদের আশা আকাক্সক্ষার প্রতীক, দাবি আদায়ের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে একটি স্বাধীন মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধের ময়দানে হাজির হয়। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত, দুই লক্ষ মা—বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেখা দেয় সেই বহু আকাক্সিক্ষত মহামুক্তি। অর্জিত হয় বিজয়। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, বাংলাদেশ।
প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর বাঙালি জাতিকে দীর্ঘ চব্বিশ বছর পাকিস্তানি শোষকদের নির্মম শোষণের শিকার হতে হয়। ক্ষুব্ধ বাঙালি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মৃত্যুপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬ মার্চ বাঙালির স্বকীয়তা বাস্তবায়নে সশস্ত্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার দিন। পরম কাঙ্খিত স্বাধীনতা অর্জনে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরুর দিন। গৌরবময় এই দিনটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘মহান স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাঙালি জাতি গর্বের সাথে প্রতি বছর এই দিনটি পালন করে ।
স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য অপরিসীম। এই দিনটি আমাদের জন্য একই সঙ্গে আনন্দ—বেদনার অনুভূতি জাগায়। একদিকে স্বজন হারানোর কষ্ট অন্যদিকে প্রাপ্তির আনন্দ। তবে শেষ পর্যন্ত সর্বস্ব হারিয়েও স্বাধীনতা প্রাপ্তির অপার আনন্দই বড় হয়ে ওঠে প্রতিটি বাঙালির কাছে। গৌরবোজ্জ্বল এই দিনটি প্রতি বছর আমাদেরকে আত্মত্যাগ ও আত্মপরিচয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং সেই সাথে মনে করিয়ে দেয় দেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সকল প্রকার বিভক্তি ভুলে একতাবদ্ধ হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা প্রদান করে এই দিনটি।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।