স্বাধীনতার ৫০ বছরে পাকিস্তানের চেয়ে দ্বিগুণ এগিয়ে বাংলাদেশ

প্রকাশিতঃ 10:35 am | December 04, 2021

নিজস্ব সংবাদদাতা, কালের আলো:

নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হলে যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার মতো সত্যিকার অর্থেই কি ছিল? নিশ্চিত পরাজয় জেনে ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের একটি বড় অংশকে পাকিস্তান কর্তৃক হত্যা করা হয় জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে পঙ্গু করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। যুদ্ধ শেষে সব ধরনের অবকাঠামো যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। স্বাধীন হওয়ার পর ক্ষুধার্ত জনগণকে যখন দু’বেলা খাইয়ে রাখা কষ্টকর সেখানে ঘুরে দাঁড়ানো যেন অবাস্তব।

এমন অবস্থায় বহির্বিশ্ব বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করত। অথচ স্বাধীনতার ঠিক পঞ্চাশ বছর পর এসে সেই দেশটি এখন অর্থনীতিতে সমীহ জাগানো একটি দেশ। কেবল দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, এশিয়া অন্যতম সেরা অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। আর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সব সূচকে সেই পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে বাংলাদেশ, বেশকিছু সূচকে ভারতকেও পিছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের বিষয় আলোচিত হচ্ছে অনেকদিন থেকে। প্রশংসা আসছে স্বয়ং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও।

প্রায় দুই বছর আগের কথা, পাকিস্তানে তোলপাড় ফেলে দেয় ‘দ্য নেশন’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কলাম। ‘দ্য বাংলাদেশ মডেল’ শিরোনামে এই লেখায় বাংলাদেশকে পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য মডেল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ নিয়ে পাকিস্তানে হয় ব্যাপক আলোচনা। পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞরা দুই দেশের বিভিন্ন সূচকে অবস্থান পরিষ্কার করেন এবং বাংলাদেশকে তাদের জন্য উন্নয়নের মডেল হিসেবে চিহ্নিত করেন। সম্ভবত এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বিজয়।

ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে জানায় ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ২৫তম অর্থনীতির দেশ হবে। এছাড়া অন্যান্য অর্থনৈতিক জরিপের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০৪৩ সাল নাগাদ ২১তম শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশ হতে যাচ্ছে। মাথাপিছু আয়ের হিসাবে প্রায় চার বছর আগেই পাকিস্তানকে অতিক্রম করে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২২২৭ মার্কিন ডলার যা গতবছর ছিল ২০৬৪ মার্কিন ডলার। করোনার মধ্যেও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৯ শতাংশ। অন্যদিকে বর্তমানে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ১৫৪৩ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে পাকিস্তানের তুলনায় যোজন যোজন এগিয়ে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ মোট জিডিপির হিসেবেও পাকিস্তানকে পিছনে ফেলেছে ২ বছর আগে। করোনা মহামারির আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। যা বিশ্বে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে ছিল অন্যতম। মাথাপিছু জিডিপিতেও পাকিস্তানকে তিন বছর আগে পিছনে ফেলে বাংলাদেশ। শিক্ষার হার কিংবা গড় আয়ুর দিক থেকে পাকিস্তান থেকে অনেকটা এগিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২.৩ বছর এবং পাকিস্তানে ৬৭.১ বছর। বাংলাদেশের শিক্ষার হার ৭৩.৯%, যেখানে পাকিস্তানে শিক্ষার হার মাত্র ৫৯.১৩%। এছাড়া বিভিন্ন রিপোর্ট সমীক্ষা অনুযায়ী অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচকে ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ, এছাড়া গণতন্ত্রের সূচকেও পাকিস্তানের চেয়েও ভালো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

বিভিন্ন সামাজিক সূচক যেমন শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি, জন্মহার, উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধাসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের অগ্রগতি বেশ ভালো। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানে এই হার ২ শতাংশ। এছাড়া প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে বাংলাদেশে মারা যায় ২২ জন, আর পাকিস্তানে মারা যায় ৬১ জন শিশু।

পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পরের ৩০ বছর অনেক সূচকেই পাকিস্তানের অবস্থান ছিল বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণ। এরপর থেকে ব্যবধান ক্রমেই কমিয়ে আনে বাংলাদেশ। আর বর্তমানে সব সূচকেই পাকিস্তানের থেকে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। একজন পাক বিশ্লেষক দাবি করেন এমন অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালে বাংলাদেশের কাছে সাহায্য চাওয়া লাগতে পারে পাকিস্তানের!

সর্বশেষ এক দশকে সব সূচকে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে বাংলাদেশের। হেনরি কিসিঞ্জারের সেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল। তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন উন্নয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সহিংসতা বাঁধা হয়ে না দাঁড়ালে হয়তো আরও ভালো অবস্থানে থাকত বাংলাদেশ। এছাড়া ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয় প্রায় প্রতিবছর। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে রপ্তানি, রিজার্ভ, জিডিপি থেকে শুরু করে দেশের বাজেটের আকার, রাজস্ব আয়, রেমিট্যান্স, দারিদ্র্য নিরসন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো তৈরি ও উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়নে সাফল্য এসেছে। এসব সূচকে পাকিস্তানকে পিছনে ফেলা সম্ভবত যুদ্ধের ৫০ বছরে বাংলাদেশের সব থেকে বড় অর্জন।

কালের আলো/এনএল/বিএসবি