কামান দাগাতে হবে না, মশা মারুন

প্রকাশিতঃ 10:54 am | February 24, 2020

প্রভাষ আমিন :

সবসময় আমরা বলি ভুল বা বিপদ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, আমরা আসলে কোনো শিক্ষাই নেই না। গত মৌসুমে ডেঙ্গু যে ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়েছিল, আমি ভেবেছিলাম, এবার বুঝি ডেঙ্গু মৌসুম শুরুর আগেই মশার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। ডেঙ্গুর আক্রমণ শুরুর পর চিৎকার-চেচামেচি করার চেয়ে যাতে ডেঙ্গু হতে না পারে সেই ব্যবস্থা করাই ভালো। আর ব্যবস্থাটা সবাই জানেন- সময়মতো মশা মারতে হবে। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকরা কথায় কামান দাগাতে যতটা ওস্তাদ, মশা মারতে ততটা নন। মশা তো মরছেই না উল্টো, মশার বংশবৃদ্ধির এমন সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে, যাতে মশা চৌদ্দগোষ্ঠীসহ বাড়ছে। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, এখনই ব্যবস্থা না নিলে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে মশার ঘনত্ব সব রেকর্ড ছাড়াবে। তার মানে কপালে এবারও খারাপি আছে।

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, বাংলাদেশে ১২৩ প্রজাতির মশা রয়েছে। তার মধ্যে ঢাকা শহরেই রয়েছে ১৩ প্রজাতির। সব মশাই ক্ষতিকর, অন্তত বিরক্তিকর। মশার কামড়ে ছড়িয়ে পড়ে অনেক রোগজীবাণু। আর কানের কাছে মশার প্যানপ্যান করার চেয়ে বিরক্তিকর আর কিছু নেই। আর সমস্যাটা আরও জটিল, মশার কয়েল আমি সইতে পারি না, দম বন্ধ হয়ে আসে। আর মশারিতে নিজেকে বন্দি-বন্দি লাগে। তবে মশা এমন ভয়ঙ্কর এখন যে নিজেকে বন্দি করে রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তবে মশার মধ্যে এখন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো- এডিস। এই মশা হলো ডেঙ্গুর বাহক।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে মেয়রপ্রার্থীরা সম্ভব-অসম্ভব অনেক প্রতিশ্রুতি দেন। কেউ সিঙ্গাপুর বানিয়ে দেন, কেউ লন্ডন। কিন্তু আমরা বুঝি, এসবই বাত কি বাত। সিটি করপোরেশনের মেয়রের প্রধান কাজ দুটি- প্রতিদিন ময়লা পরিষ্কার করা আর মশা মারা। এ দুটি কাজ করতেই মেয়রদের নাভিশ্বাস। প্রতিদিন গৃহস্থালি বর্জ্য অপসারণের তবু একটা সিস্টেম দাঁড়িয়েছে, কিন্তু রাস্তাঘাট এখনও অনেক ময়লা, ঢাকার খালগুলো সব ময়লায় অচল হয়ে গেছে। আর এই ময়লা হলো মশার বংশবিস্তারের জন্য সবচেয়ে ভালো।

মশা মারার ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতা নিয়ে গত মৌসুমে অনেক আলোচনা হয়েছে। মশা মারতে ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে, ওষুধের পর্যাপ্ততা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। তাতেও ছড়িয়ে পড়া মশা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। মেয়ররা শেষ পর্যন্ত মশাকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কবে বৃষ্টি থামবে, ডেঙ্গুর মৌসুম শেষ হবে; সে প্রার্থনাই ছিল তাদের শেষ ভরসা। গতবছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছিল। প্রার্থনায় হোক আর প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে হোক বৃষ্টি থেমেছিল। কিন্তু ডেঙ্গুর মৌসুম যে কদিন পরেই আবার আসবে সেটা বোধহয় ভুলেই গিয়েছিলেন আমাদের নগরপিতারা। এবার ডেঙ্গুর মৌসুম শুরুর আগেই নগরবাসী দারুণ এক মাইনকা চিপায় পড়েছেন।

ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নতুন মেয়র নির্বাচিত হলেও তারা এখনও দায়িত্ব পাননি। আগামী ১৭ মে পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণের মেয়রের দায়িত্ব পালন করবেন সাঈদ খোকন। আর ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম দায়িত্ব নেবেন ১৪ মে। এখন ১৪ মে পর্যন্ত ঢাকার মশাদের কী হবে? ধারণা করা হচ্ছে, গত মৌসুমে মশা মারতে ব্যর্থতার কারণেই সাঈদ খোকন এবার মনোনয়ন পাননি। তো মনোনয়ন বঞ্চিত, হতোদ্যম বিদায়ী মেয়র কি এই সময়ে মশা মারতে উদ্যোগী হবেন। যখন পুরোদমে মেয়র ছিলেন, তখনই যেটা পারেননি, এখন শেষবেলায় তিন আর কতটুকু করবেন বা পারবেন?

একই অচলাবস্থা উত্তরেও। অথচ মে পর্যন্ত সময়টাই ডেঙ্গুর জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ। এই সময়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারলে বর্ষাকালটা অনেককে হাসপাতালের বিছানায়ই থাকতে হবে। গত মৌসুমে ডাক্তাররা জানপ্রাণ দিয়ে খেটে মানুষের পাশে দাঁড়ানো ছাড়া আর কিছুই শিখতে পারিনি আমরা। এমনকি একপর্যায়ে ডেঙ্গু পরীক্ষার রি-এজেন্টও ফুরিয়ে গিয়েছিল। এই মুহূর্তে, এখনই যদি সিটি করপোরেশন মশা মারার কার্যকর উদ্যোগ না নেয়, তাহলে আবারও আমাদের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হতে পারে। কিন্তু তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

তবে সব দায়িত্ব মেয়রদের হাতে দিয়ে, তাদের ব্যর্থ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার চেয়ে নিজেদের কাজটুকু করে রাখা ভালো। এডিস মশা ঠেকানোর কৌশল আমাদের সবার জানা। কোথাও ময়লা রাখা যাবে না, পানি জমতে পারে, এমন কোনো ব্যবস্থা যেন না থাকে। এখন থেকেই যদি আমাদের চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখি; পরিত্যক্ত ডাবের খোসা, টায়ার, নজরের বাইরে থাকা ফুলের টব, নির্মাণকাজের খানাখন্দ যেন এখন দূর করে রাখি।

আমরা দেখছি বাংলাদেশে যেকোনো কাজে হয় প্রধানমন্ত্রী নয় হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ লাগে। এটা হওয়া উচিত নয়। কিন্তু যেহেতু এটাই এখন বাস্তবতা, তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, আপনি এখনই সংশ্লিষ্টদের মশা মারার নির্দেশ দিন। হাইকোর্টকেও অনুরোধ মৌসুম শুরুর আগেই আপনারা প্রয়োজনেও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হলেও মশা মারার নির্দেশ দিন। কারণ ডেঙ্গু যখন আসে, তখন কিন্তু ধনী-গরিব, মন্ত্রী-এমপি কিছুই মানে না।

গতবার অর্থমন্ত্রীর ডেঙ্গুর জন্য তার জীবনের প্রথম বাজেটটি ঠিকমতো পেশ করতে পারেননি। এখনই উদ্যোগ না নিলে আমাদের আবারও বর্ষাকাল ছোট করার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে আর অপেক্ষা করতে হবে, কখন ডেঙ্গু মৌসুম ফুরাবে। আমরা তো সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি, কোনো বিপর্যয় থেকে আমরা কিছুই শিখব না। শুধু আক্রান্ত হলে কান্নাকাটি করব, গালাগালি করব আর আকাশের দিকে চেয়ে থাকব।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ

Print Friendly, PDF & Email