ফুলবাড়ীয়ার ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলায় লাখো মানুষের ঢল
প্রকাশিতঃ 12:45 am | January 14, 2018
কালের আলো রিপোর্ট: পৌষ মাসের শেষ দিনকে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলায় আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় পুহুরা। জমিদার আমল থেকে প্রতি বছর পৌষ মাসের শেষ দিন লক্ষিঁপুর বড়ইআটা গ্রামে ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলা অনুষ্ঠিত।
শনিবার বিকেল ৪ টায় আনুষ্ঠানিক ভাবে লক্ষিপুর গ্রামে হুমগুটি খেলার উদ্বোধন করে জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মোঃ মমতাজ উদ্দিন। এসময় জেলা পরিষদ সদস্য তাজুল ইসলাম বাবলু, কাউন্সিলর সৈয়দ শফিকুল ইসলাম মিন্টু, আবু বক্কর সিদ্দিক প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধন শেষ লক্ষিপুর ও দশমাইলের মাঝামাঝি তেলিগ্রাম বড়ই আটা গ্রামে যেখানে জমিদার আমলে তালুক বনাম পরগনার জমির সীমানায় হাজারো খেলোয়াড়ের মাঝে হুমগুটি (৪০ কেজি ওজনের একটি পিতলের তৈরী বল ) ছেড়ে দেওয়া হয়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখাযায় কণকণে শীত উপেক্ষা করে ঐতিহ্যবাহী হুমগুটি খেলায় লাখো মানুষের ঢাল নামে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত লক্ষিপুর গ্রামেই খেলাটি চলছিল।
গতকাল ময়মনসিংহ সদর, ত্রিশাল, মুক্তাগাছা ও ফুলবাড়ীয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে ভোর হতে নেতৃত্বস্থানীয়রা স্ব স্ব ইউনিয়নের বাদ্যযন্ত্রের বাজিয়ে ও মাইকিং করে নিদৃষ্ট স্থানে একত্রিত করে খেলোড়ারদের। দুপুর থেকে দলে দলে বিভক্ত হয়ে হাজার হাজার খেলোয়াড়রা খেলার মাঠে আসতে শুরু হয়।
খেলা উপলক্ষে লক্ষীপুর, বড়ই আটা, ভাটিপাড়া, বালাশ্বর, শুভরিয়া, কালিবাজাইল, তেলিগ্রাম, সারুটিয়া, গড়বাজাইল, বাসনা, দেওখোলা কুকরাইল, বরুকা, আন্ধারিয়াপাড়া, জোরবাড়িয়া, ফুলবাড়ীয়া, কাতলাসেন সহ আশপাশের ৮/১০ টি গ্রামে ব্যাপক আনন্দ উৎসব দেখা যায়। খেলার কেন্দ্রস্থলের পাশেই বসেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মেলা।
জানাগেছে, মুক্তাগাছা জমিদার রাজা শশীকান্তের সাথে ত্রিশালের বৈলরের হেম চন্দ্র রায় জমিদারের জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। জমিদার আমলের শুরু থেকে তালুকের প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল ১০ শতাংশে ও পরগনার প্রতিকাঠা জমির পরিমাপ ছিল সাড়ে ৬ শতাংশে কাঠা। একই জমিদারে ভূখন্ডে দুই নীতির প্রতিবাদে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে উঠে প্রজাদের মধ্যে। জমির পরিমাপ সৃষ্ট বিরোধ মীমাংসাকল্পে লক্ষিপুর গ্রামের বড়ই আটা গ্রামে তালুক পরগনার সীমানায় প্রজাদের শক্তি পরীক্ষার জন্য ‘হুমগুটি খেলা’র আয়োজন করেছিলেন জমিদাররা। হুমগুটি খেলার শর্ত ছিল, নিদৃষ্ট ওজনের পিতলের গুটি’টি যে দিকে যাবে তা হবে পরগনা ও পরাজিত অংশের নাম হবে তালুক। জমিদার আমলের গুটি খেলায় মুক্তাগাছা জমিদারের প্রজারা বিজয়ী হয়। সেই থেকে এ অঞ্চলের জমির পরিমাপ সাড়ে ৬ শতাংশে এক কাঠা।
মোহাম্মদ নগর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষাক মোঃ মোন্নাফ হোসেন জানান, হুমগুটি খেলা ফুলবাড়ীয়া ঐতিহ্য। জমিদার আমল থেকে তেলিগ্রাম বড়ই আটা গ্রামে খেলাটি চলে আসছে,
হুমগুটি খেলায় নেই কোন রেফারী, নিদিষ্ট কোন সময় নেই এমনকি নিদিষ্ট খেলোয়াড়ের সংখ্যাও নেই তবুও কোন ঝগড়া বিবাদ হয় না। তবে শেষ পর্যন্ত খেলায় খেলোয়াড়রা পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ চারটি ভাগে ভাগ হয়ে হুমগুটি’টি নিজেদের দখলে নেয়ার চেষ্টা চালায়।
হুম গুটি খেলা স্মৃতিসংসদের সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, জমিদার আমলের তালুক ও পরগণা প্রজাদের দলগত শক্তি পরীক্ষার জন্যই তালুক ও পরগণার সীমানায় হুমগুটি খেলার আয়োজন করেছিল। আমাদের পূর্ব পুরুষরা যুগ যুগ হুম খেলাটি ধরে রেখেছে তারই ধারাবাহিকতায় ঐতিহ্যটি ধরে রাখতেই প্রতি বছর পৌষ মাসের শেষ দিন বড়ইআটা গ্রামে হুমগুটি খেলার আয়োজন করি।হুমগুটি খেলা বেশির বাগ ১ থেকে ২ দিন হয়, দাদার আমলে টানা ৫ দিন খেলা চলার রেকর্ড রয়েছে।
বালিয়ান ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মফিজ উদ্দিন মন্ডল জানান, হুমগুটি খেলা হলো কৃষকের শক্তি পরীক্ষার খেলা, দাদার দাদা’রা এ খেলা খেলেছেন। খেলায় বিজয়ী হওয়ার জন্য বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ একত্র হয়ে খেলতে আসেন। গত দুই বছর যাবৎ আমার দল হুম গুটি খেলায় বিজয়ী হয়েছে। আজকে (শনিবার) কয়েক হাজার খেলোয়াড় নিয়ে এসেছি খেলতে।