‘আল্লাহর কসম লকডাউন’

প্রকাশিতঃ 10:10 am | April 12, 2021

প্রভাষ আমিন :

গত সপ্তাহে এই কলামে লিখেছিলাম ‘লকডাউনেই হোক করোনা ডাউন’। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টো। লকডাউনের সময়ই করোনা ডাউন না হয়ে আপ হয়েছে। এই সময়ে করোনা সংক্রমণ এবং মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে বারবার। তবে এই নতুন নতুন রেকর্ডের দায় মোটেই তথাকথিত ‘লকডাউন’র নয়। লকডাউনের আগেই আমাদের সীমাহীন উদাসীনতা আর খামখেয়ালির দায় টানতে হচ্ছে এখন সবাইকে।

করোনা যখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছিল, আমরা সবাই করোনা জয়ের আনন্দে দলে দলে মাঠে নেমে পড়েছিলাম। এই সময়ে আন্দোলন, সংগ্রাম, হরতাল, মারামারি, সভা, সমাবেশ, বেড়ানো, খেলানো সবই হয়েছে। এই ফাঁকে করোনার ঢেউ সুনামি হয়ে আমাদের সবাইকে গ্রাস করে নিতে বসেছে। করোনা মোকাবিলায় আমাদের যা কিছু অর্জন, আমাদেরই খামখেয়ালিতে সব এখন ভেসে যেতে বসেছে। এই সময়ে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট, আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট সব দেশে ঢুকে পড়েছে। এই উদাসীনতার দায় অবশ্যই আমাদের। তবে টিকার তাতে কিছুটা দায় আছে।

ঢাকার গণপরিবহনে যখন প্রথম গেটলক সিটিং সার্ভিস এলো, তখন বাসের গেটে লেখা থাকত ‘গেটলক সিটিং সার্ভিস’। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সিটিং সার্ভিস চিটিং সার্ভিস হয়ে গেল। গেট আর লক থাকে না, সারাক্ষণ খোলাই থাকে। এরপর এলো, ‘মায়ের কসম গেটলক’, ‘আল্লাহর কসম গেটলক’। এবারের কঠোর লকডাউন যেন ‘আল্লাহর কসম লকডাউন’ হয়। আবার যদি ঢিলেঢালা লকডাউন হয়, আমরা যদি সরকারের সাথে চোর-পুলিশ খেলি; তবে আমরা নিজেদের সাথেই প্রতারণা করবো।

অন্য অনেক দেশকে পেছনে ফেলে দারুণ সাফল্যে আমরা যখন টিকা পেলাম; সবাই ভেবেছি, আর কোনো ভয় নেই। কিন্তু বারবার বলা হচ্ছে, টিকা করোনা মুক্তির একমাত্র উপায় নয়। উপায় হতো, যদি দেশের অন্তত ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দেয়া যেত। কিন্তু ১৮ কোটি মানুষের দেশে টিকা পেয়েছে মাত্র ৫৫ লাখ মানুষ। টিকা সহজলভ্য হলেও বিশ্বের ৮০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে তিন-চার বছর সময় লাগবে। তাই টিকার আশায় বসে না থেকে আমাদের উচিত ছিল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারেই আমাদের যত অনীহা, হাজারটা অজুহাত।

একমাত্র না হলেও করোনা মোকাবিলায় টিকা একটি উপায় বটে। তবে সবচেয়ে বড় উপায় হলো, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। স্বাস্থ্যবিধিটা কিন্তু আমাদের সবার জানা। অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে, পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, বারবার হাত ধুতে হবে। স্বাস্থ্যবিধির সবগুলো কিন্তু আমাদের নিজেদের ওপর। আমরা চাইলেই এগুলো মেনে চলতে পারতাম। কিন্তু মানিনি। সরকার অনেক চেষ্টা করেও আমাদের মানাতে পারেনি। প্রথম দফায় আমরা ছুটির আনন্দে ৬৬ দিনের ‘সাধারণ ছুটি’ কাটিয়েছি। অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে, নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট হয়েছে; কিন্তু লাভ পুরোপুরি হয়নি।

দ্বিতীয় দফায় গত ২৮ মার্চ সরকার ১৮ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল, আমরা মানিনি। বাধ্য হয়ে সরকার ১ এপ্রিল থেকে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করলো। কিন্তু নামকাওয়াস্তে সেই লকডাউনও সরকার কার্যকর করতে পারেনি। লকডাউন ঘোষণার দুদিন পর অনুমতি দেয়া হয় গণপরিবহন চলার, তার দুদিন পর খুলে দেয়া হয় শপিংমল। লকডাউনকে ঈদের ছুটি মনে করে আমরা স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে দলে দলে গ্রামে চলে গেলাম। আমার আশঙ্কা এই ঢিলেঢালা লকডাউনের প্রভাবে করোনা সারাদেশে বিস্তৃত হতে পারে।

লকডাউনের কথা এলেই সামনে আসে জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন, অর্থনীতি সচল রাখার দাবি। তবে মানতেই হবে, জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। জীবনই যদি না বাঁচলো, জীবিকা দিয়ে কী হবে। তাই করোনার ভয়ঙ্কর সুনামি মোকাবিলায় কার্যকর লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও বারবার কার্যকর লকডাউনের কথাই বলছেন। তাই বারবার নামকাওয়াস্তে সাধারণ ছুটি, ঢিলেঢালা লকডাউন না দিয়ে অবিলম্বে একটি কার্যকর ও কঠোর লকডাউন দরকার।

সরকার আপাতত ১৪ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক সপ্তাহ নয়, যে কোনো লকডাউন কার্যকর করতে হবে অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য। কারণ করোনা বিস্তারের টাইমলাইনটা হলো দুই সপ্তাহের। গত এক বছরে সরকার সাধারণ ছুটি, লকডাউন দিয়ে এর সুবিধা-অসুবিধা সব জেনেছে। কার্যকর লকডাউনে যাওয়ার আগে তাই অসুবিধাগুলো বিবেচনায় আনতে হবে।

প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশে সত্যিকারের প্রান্তিক মানুষ কারা, সেটা জানা কোনো সমস্যা নয়। তাদের দরজায় সরকারের সাহায্য পৌঁছে দেয়াও কোনো সমস্যা নয়। সরকারের অর্থের অভাব আছে তেমনও নয়। বড়লোকদের জন্য প্রণোদনার আগে গরিব মানুষের জীবন বাঁচানোটা বেশি জরুরি। জীবন বাঁচলে পরেও প্রণোদনা দেয়া যাবে। আপাতত দিন এনে দিন খাওয়া মানুষদের দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়া নিশ্চিত করে কঠোর লকডাউনে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

কিন্তু কঠোর লকডাউন কতটা ‘কঠোর’ হবে, তা নিয়ে আমার সংশয় রয়েছে। অতীতের সাধারণ ছুটি এবং চলমান লকডাউনের নামে যে হাস্যকর ব্যাপার-স্যাপার হয়েছে; তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়। মানুষের জীবন বাঁচাতেই স্বাস্থ্যবিধি পালন এবং লকডাউন প্রয়োগে মানুষের ওপর আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদেরও নিজেদের স্বার্থে সরকারের নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে হবে। অতীতের মতো আমরা যেন পুলিশের সাথে চোর-পুলিশ না খেলি। আমরা যেন জনসমাগম এড়িয়ে চলি, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া যেন ঘর থেকে না বের হই, বেরুলেও যেন অবশ্যই মাস্ক পরি, স্বাস্থ্যবিধি যেন মেনে চলি। একটা ব্যাপার আমাদের সবাইকে মেনে নিতে হবে, করোনাপূর্ব পৃথিবী আমরা আর কখনোই ফিরে পাবো না। তাই আমাদের ‘নিউ নরমাল’ জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে। এটা ছাড়া বাঁচার কোনো উপায় নেই।

সরকারের কঠোর লকডাউনের ঘোষণায় একটা গল্প মনে পড়লো। ঢাকার গণপরিবহনে যখন প্রথম গেটলক সিটিং সার্ভিস এলো, তখন বাসের গেটে লেখা থাকত ‘গেটলক সিটিং সার্ভিস’। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সিটিং সার্ভিস চিটিং সার্ভিস হয়ে গেল। গেট আর লক থাকে না, সারাক্ষণ খোলাই থাকে। এরপর এলো, ‘মায়ের কসম গেটলক’, ‘আল্লাহর কসম গেটলক’। এবারের কঠোর লকডাউন যেন ‘আল্লাহর কসম লকডাউন’ হয়। আবার যদি ঢিলেঢালা লকডাউন হয়, আমরা যদি সরকারের সাথে চোর-পুলিশ খেলি; তবে আমরা নিজেদের সাথেই প্রতারণা করবো। করোনায় প্রতিটি মৃত্যুর দায় হবে যতটা সরকারের, ততটাই আমাদের। সবাইকে ভালো থাকতে হলে, সবাইকে সাবধান থাকতে হবে।

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ

Print Friendly, PDF & Email