ফেব্রুয়ারি এলেই…
প্রকাশিতঃ 10:29 am | February 26, 2021

ড. মো. ফখরুল ইসলাম:
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলা ভাষার ওপর নানা চিন্তাভাবনা শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন সেমিনার, গ্রন্থমেলা, আলোচনা সভায় বাংলা ভাষার ভালো-মন্দের ওপর ব্যবচ্ছেদ চলে। অনেকের একুশের প্রতি দরদের মাত্রা যেন উথলে ওঠে। তারা বাংলা ভাষার ওপর নানা পরামর্শ ও প্রতিশ্রুতি দেন। কেউ কেউ সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দ্রুত তাগিদও দেন।
তবে ফেব্রুয়ারি মাসটি শেষ হলেই যেন সবাই সব কিছু বেমালুম ভুলে যেতে বসেন। এভাবে প্রতি বছর একুশের প্রতি দরদ-তাগিদ শুধু এক মাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা যায়। অবস্থাদৃষ্টে অনেকে এটাকে বাংলা ভাষার প্রতি প্রতারণা ও অমর্যাদাকর বিষয় বলে মনে করেন। কারণ, আমরা অনেকে দায়িত্বশীল পদে থেকে নানা প্রতিশ্রুতির কথা জনসম্মুখে বললেও কার্যত সেগুলো বাস্তবায়ন করতে অনীহা ও অপারগতা দেখাই। ফলে ইতিবাচক কোনো নীতিমালা অদ্যাবধি গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এর প্রভাব আমাদের প্রিয় মাতৃভাষাকে ব্যবহারিক দিক দিয়ে ভীষণ নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। আমরা এর প্রতিকার করার উপায় খুঁজে পাচ্ছি না; বরং উল্টো এই নাজুক অবস্থাকে লাইসেন্স ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে লালন করছি।
সেদিন পার্কে এক বিদেশিনীকে চমৎকারভাবে বাংলা ভাষায় কথা বলতে দেখে কিছুটা আবেগাপ্লুত স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার দেশ কোথায়? কীভাবে বাংলা ভাষা শিখলেন? তিনি বলেন, ‘আমেরিকা। পরিবারের কাছে বাংলা শিখেছি।’ বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কেমন জানতে চাইলে তিনি উত্তরে যা বললেন তা শুনে আমি কিছুটা বিব্রত হলাম।
তিনি শোনলেন, আপনারা কথা বলার সময় ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলেন। তাতে বিদেশিদের সহজে বোঝার উপায় নেই যে আপনি আসলে কোন ভাষায় কথা বলছেন। ধরুন, আপনি একটি সেমিনারে বক্তার উত্তরে বললেন, ‘আপনার কমেন্টগুলোকে স্ট্রংলি সাপোর্ট করছি।’ এ বাক্যে তিনটি বাংলা ও তিনটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করলেন। এতে বোঝা গেল না- এটা আসলে কোন ভাষা!
এভাবে এফএম রেডিও, টিভি- সবখানেই মিশ্রভাষা ব্যবহার করা হয়; যেটা বাংলা ভাষার নিজস্ব ব্যবহার বিধি ও মর্যাদাকে নষ্ট করছে। বিদেশিনীকে যুক্তি দিয়ে আমাদের ভাষার দুর্বল ব্যবহারবিধি চিহ্নিত করতে দেখে লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে গেল। বাংলা ভাষায় এভাবে মিশ্রণ করতে গিয়ে ইংরেজি শব্দগুলোকেও আমরা বিকৃতভাবে উচ্চারণ করি। সেটাও বিদেশিদের জন্য বোঝা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।
অবাধ ইন্টারনেটের যুগে ভিনদেশি কৃষ্টি-সংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের বাংলা ভাষার নিজস্ব ব্যবহারবিধি ও স্বকীয়তা থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে। শিশুরা হিন্দি কার্টুন দেখে হিন্দিতে কথা বলছে। সেদিন এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে বিদেশিদের উপস্থিতিতে একজন বলতে লাগলেন, এটা ভাষার মাস; তাই বাংলায় কথা বলতে হচ্ছে।
বিদেশিদের উপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে এগুলো বলাটা আমার কাছে মনে হল ন্যাকামি। এখানে তিনি তার দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন। ফেব্রুয়ারি মাস বলে এভাবে বাংলা ভাষাকে মর্যাদা দেয়াটা ভালো দেখায় না। একজন তো মন্তব্য করেই বসলেন, ‘বাকি ১১ মাস কোনো তাগিদ নেই; আর এক মাসের জন্য দরদ উথলে উঠল?’
একুশের সেমিনারে বাংলা ভাষার প্রতি দরদ দেখাই, ইংরেজির তুলাধোনা করি, আর সেমিনার শেষে বাসায় ফিরেই ড্যাডি, মাম্মি, গুড মর্নিং বলার চর্চা করি। এই আমাদের মাতৃভাষার প্রতি দরদের নমুনা। এদিকে আমরা স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করার জন্য বায়না ধরি। অপরকে পরামর্শ দিই। এটাও মাতৃভাষার প্রতি কপটতা করার শামিল।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কৃত্রিম মেধা ও বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ইংরেজি ও অঙ্ককে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেলেও ডিজিটাল মানদণ্ডের মাধ্যম হিসেবে আমরা বাংলা ভাষাকে এখনও বেশি দূর এগিয়ে নিতে পারিনি। এখনও বাংলায় কেউ ই-মেইল করতে আগ্রহ দেখায় না। মোবাইল ফোনের মেসেজটাও বাংলা হরফে না লিখে ইংরেজি হরফে লিখে থাকে।
এছাড়া বাংলা ভাষায় প্লেজারিজম পরীক্ষা করার মতো এন্টি-প্লেজারিজম সফটওয়্যার এখনও তৈরি হয়নি বিধায় বাংলা পাণ্ডুলিপি ও বাংলায় কৃত গবেষণা রিপোর্টের ওপর একাডেমিক নকল ও চৌর্যবৃত্তি ধরার বা পরীক্ষা করার ক্ষেত্র তৈরি হয়নি। যুগের প্রয়োজনে এটা তৈরিতে মনোনিবেশ করা জরুরি। বাংলা একাডেমির অধীনে সেই ১৯৫৫ সালে অনুবাদ শাখা খোলা হলেও এখনও বলা হয় বরাদ্দ কম।
আমরা জানি, অনুবাদ হলো একটি দেশের গোপন দূত। অনূদিত বই-পুস্তকের মাধ্যমে আমরা বিদেশকে জানতে পারি, বিদেশ আমাদের চিনতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনূদিত বই দিয়ে নোবেল পুরস্কার মনোনয়ন দেয়া হয়। অথচ এখনও আমরা নিজেদের মধ্যে ইংরেজিপ্রীতি পুষে চলি। আমরা এটাও জানি যে, যিনি তার মাতৃভাষা ভালো দখল রাখেন; তিনি সহজেই যে কোনো বিদেশি ভাষাকেও আয়ত্তে নিতে পারঙ্গম।
তাই এখন সময়ের দাবি, বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ বন্ধ করুন। এফএম রেডিওর নামে বিকৃত বাংলা উচ্চারণ বলে আমাদের মাতৃভাষাকে আর অমর্যাদা করবেন না। টিভি, কনসার্ট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুদ্ধ ও নির্ভুল বাংলা ব্যবহার করুন। মিশ্র বাংলা পরিহার করুন। তা না হলে বিদেশিরা আমাদের বিকৃত কথা শুনে উপহাস করতেই থাকবে।
ব্রিটেনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী এখন বাংলা ভাষী। জাতিসংঘ বাংলা ভাষাকে অনেক আগেই মর্যাদার আসনে বসিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে বিশ্বদরবারে বিশেষ আসনে অলঙ্কৃত করেছে। এখনও আমাদের দেশে বাংলায় অনূদিত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পাঠ্যবই নেই। আমাদের শিক্ষা, গবেষণা, উন্নয়ন সবকিছুর বৈশ্বিক পরিচিতি ও স্বীকৃতি আদায়ে বিদেশি ভাষার বই-জার্নাল বাংলা ভাষায় বেশি বেশি অনুবাদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়া জরুরি।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।