দীপন হত্যার বিচার ও প্রসঙ্গ কথা

প্রকাশিতঃ 10:20 am | February 13, 2021

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:

সেই এক সময় এসেছিল এ দেশে। দেশজুড়ে হঠাৎ শুরু হল লেখক ও ব্লগার হত্যা। বিদেশি নাগরিক হত্যা। মূলত শাহবাগে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে শুরু হওয়া গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে মুক্তমনা মানুষকে নাস্তিক উপাধি দিয়ে বাংলাদেশকে সহিংসতার জমিতে পরিণত করল একটি গোষ্ঠি। ঢাকায় বা ঢাকার বাইরে কোথাও রক্ষা পাচ্ছিলেন না উদার ও নৈতিক মানুষেরা। বিশেষ করে যারা লেখালেখি করেন তারা।

ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মানুষ হত্যার অনেকগুলোর একটি ঘটনা ছিল জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা। ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটের নিজ অফিসে দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। জঙ্গিরা দীপনকে টার্গেট করেছে লেখার জন্য নয়, তাদের ভাষায় কোন এক নাস্তিকের বই প্রকাশের জন্য। গত বুধবার দীপন হত্যা মামলায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৮ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

অভিজিৎ রায়সহ অসংখ্য হত্যা মামলার রায় কবে হবে কেউ জানে না। বাংলাদেশের মানুষের, বিশেষ করে দেশ প্রেমিক মানুষের সামগ্রিক স্মৃতিতে গভীর ভাবে গেঁথে গিয়েছে সে সব হত্যার উৎসব। সে দিনের স্মৃতি, অনুভব, মনে ছাপ-পড়া ছবি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তারা বয়ে চলবেন। সময়টি আরেক কারণে জঙ্গিদের অনুকূলে ছিল। সিরিয়ায় আইএস নামের এক নিষ্ঠুরতম জঙ্গি সংগঠনের খেলাফত বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ হয়ে সারা পৃথিবী থেকে তরুণ তরুণীরা জড়ো হতে শুরু করেছিল সিরিয়ায়। বাংলাদেশ থেকেও গিয়েছিল। যারা যেতে পারেনি তারা এখানেই শুরু করেছিল খেলাফতের নামে হত্যা।

দেশজুড়ে এই হত্যার উৎসবের সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান ক্যাফেতে জঙ্গি হামলা। সেই বীভৎস ঘটনার পর সরকার নড়েচড়ে বসে এবং জঙ্গি খতমে সাফল্যও দেখায়। সেনাবাহিনী, পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনীকে বড় ঝুঁকি নিতে হয়েছে, অনেক কে জীবন দিতে হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগকে অনেক বড় ঝুঁকি নিতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক নেতা, লেখক ও বুদ্ধিজীবী এবং সাংস্কৃতিক কর্মীদের সময় কেটেছে চরম আতঙ্ক ও হতাশায়।

প্রশ্ন হল সেই আতঙ্ক ও হতাশা কি কেটে গেছে? এক কথায় উত্তর হবে ‘না’। কারণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সহিংসতার পক্ষে রাজনৈতিক উস্কানি বিদ্যমান। এবং সেখান থেকেই রামুতে বৌদ্ধদের ওপর হামলা হয়, হিন্দুদের ওপর হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, ভোলায় এবং উদার নামাজি মুসলিমকে পুড়িয়ে মারা হয় লালমনিরহাটের মসজিদ প্রাঙ্গনে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি যুদ্ধ করে গড়ে উঠেছে। সেই যুদ্ধ ছিল ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, উদারতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে। এ দেশ শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গড়ে উঠেছে এবং সেটা একটা আবেগের স্রোত। এই আবেগ সৃষ্টি হয়েছে দেশপ্রেম আর অসাম্প্রদায়িকতার পথ ধরে। এই যে নানা ধর্ম ও শ্রেণির মানুষের বহু বছর ধরে একত্রে বসবাস তার মূলে ছিল মানবিক ঐক্য, ধর্মের নামে বিভেদ নয়। একে কেন্দ্র করেই সাহিত্য-সংস্কৃতি-কৃষ্টি ও শিল্পের বিকাশ। রাজনৈতিক ও রাষ্ট্র নেতাদের কর্ম পন্থাও ঠিক করেছে একাত্তরের যুদ্ধ, তার আগের সাংস্কৃতিক জাগরণ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী দেশ গড়ার সংকল্প। কিন্তু সবই হারিয়ে গেছে উল্টো পথে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর থেকে।

এখন কেন এই সাম্প্রদায়িক শক্তির এত উল্লাস? একটা বড় কারণ রাজনীতির অভাব। হয় আছে ক্ষমতা চর্চা নয়তো বিরোধিতার চর্চা। রাজনীতিটা করছে আসলে একাত্তরের পরাজিত শক্তি এবং সেটা নানা রঙ আর পরিচয়ে। এক সময় দেশের প্রগতিশীল বাম রাজনৈতিক শক্তি যতখানি সংগঠিত ভাবে মানুষকে সচেতন ও প্রগতিমুখী করার কাজ করেছিল, সেই শক্তিতে বেশ ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সেই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে এই প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি।

জামায়াতে ইসলাম ও তার ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র শিবির এবং সাম্প্রতিক শাহবাগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গজিয়ে উঠা হেফাজতে ইসলামের মধ্যে যে পেশাদারিত্ব আছে তা নেই আমাদের উদারনৈতিক ও বাম দলগুলোর ভেতর। বর্তমান সময়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থার দিকে তাকালে মনে হয় রাজনীতি ও সমাজের অন্যান্য শাখা প্রশাখার ভেতর থেকে মেধা ও চিন্তাশক্তি নাই হয়ে যাচ্ছে।

এখানে বিশ্ব পরিস্থিতিও আবদান রাখছে। আমেরিকায় ট্রাম্প, ইউরোপে ডানপন্থী শক্তির উত্থান, রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপ থেকে সমাজতন্ত্রের বিদায়, ভারতে বিজেপির মত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তির পরাক্রমশালী হয়ে উঠা সবই মৌলবাদী শক্তি রাজনীতির রসদের জোগান দিচ্ছে। বিভিন্ন দেশেই আমরা দেখছি রাষ্ট্রশক্তিই মৌলবাদী শক্তির হাতিয়ার হয়ে উঠছে।

ভয়ের কারণ এখানেই। আমাদের মতো দেশে, বিশাল জনসংখ্যা এক মাথাব্যথার কারণ। এত মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের জন্য উদারনৈতিক শিক্ষার বন্দোবস্ত করা সম্ভব হচ্ছে না সরকারের পক্ষে। বিপুল মানুষের শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো চলে যাচ্ছে মৌলবাদীদের হাতে। এই সত্যটা বুঝতে না পারলে বিপদ আরও বাড়বে।

দীপন, অভিজিৎ-দের যখন একে একে হত্যা করা হচ্ছিল তখন আমরা নিরাপত্তাহীনতার কথা বলেছি। বলেছি কিভাবে অসহিষ্ণুতা ছড়িয়ে পড়ছে তার কথা। দীপন হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু লম্বা বিচারিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গিয়ে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা সময়ের ব্যাপার।

যে শক্তিতে আমাদের ঐক্যবন্ধন সেই শক্তি একাত্তরের শক্তি। সেখানকার চেতনা এক বার আলগা হতে শুরু করলে সমূহ বিপদ। যারা নিজেদের ক্ষুদ্র রাজনৈতিক ও অথনৈতিক স্বার্থে মৌলবাদকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছেন তারা দিনশেষে নিজেদের পথও সঙ্কীর্ণ করে ফেলছেন। মনে রাখা দরকার, মানুষের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িক হিংসাকে জাগানোর কাজ করে উদারনৈতিক রাজনৈতিক সংগঠনের ভুল রাজনীতি।

কালের আলো/ডিএস/এমএইচএ

Print Friendly, PDF & Email