ফেসবুক বিষয়ক কথকতা
প্রকাশিতঃ 11:06 am | January 11, 2018
মো: রফিকুল ইসলাম, অ্যাডিশনাল ডিআইজিঃ
গত ৬ অক্টোবর বড় মেয়ের এক ভর্তি পরীক্ষার জন্য গেছি তেজগাঁও কলেজে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘনিষ্ঠ দু’বন্ধুর সংগে দেখা। তাদের মেয়েরাও ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছে। রনজিৎ পাল শেষ বর্ষে আমার রুমমেট ছিল। দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই আমি ছিলাম হকের (প্রকৃত নাম বলতে বারন করায় ছদ্মনাম লিখতে হল) পাশের রুমে। হকের আরও দু’রুমমেট শামীম ও শৈবাল ছিল আমাদের কৃষি অনুষদেরই সহপাঠী। ফলে ওদের রুমটি হয়ে উঠেছিল আমাদের আড্ডাস্থল। কতদিন যে ওদের রুমে আড্ডা দিয়েছি, তাস খেলছি তার ইয়াত্তা নেই। কতবার যে নিউজিল্যান্ড প্রবাসী বন্ধু নিখিলেশ বা আমাদের একেবারে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বন্ধু গোপাল ব্রে হয়েছে তার ঠিক ঠিকানা নেই। আমরা পয়সা দিয়ে খেলতাম না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিকে বিকেলে বা সন্ধ্যায় নাস্তার জন্য চারজনে দশ টাকার জন্য ব্রে খেলতাম। ব্রে হলে চার টাকা, তৃতীয় হলে তিন টাকা এবং দ্বিতীয় ও প্রথমের যথাক্রমে দু’টাকা ও এক টাকা দিতে হত। মোট দশ টাকায় আশির দশকে হল কেন্টিনে চারজনের ফার্স্টক্লাস নাস্তা হয়ে যেত। বেশির ভাগ সময় প্রথম হত শৈবাল। মাঝে মধ্যে আমিও হতাম বা কখনও শামীম। ফলে সিরিয়াস পড়াশুনার সময় ছাড়া বেশির ভাগ সময় কাটতো ওদের রুমে। বর্তমানে ওদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ কম হলেও ভাল যোগাযোগ আছে।
অপক্ষার সময় তিনবন্ধু মিলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিলাম। আড্ডাবাজির এক ফাঁকে ফেসবুক নিয়ে কথা উঠতে জানা গেল রনজিৎ ফেসবুকে আছে। তবে প্রায় নিষ্ক্রিয়। হক ফেসবুকে অনুপস্থিত। তাকে জিজ্ঞেস করলাম সে নেই কেন। জানালো ভাল লাগে না। তা ভাল নাই লাগতে পারে। আমারও এক সময় ভাল লাগতো না। তবু কারন জানতে চাইলাম। সে জানালো আঁতলামির জন্য। বিষয় বুঝা গেল না। খোলাশা করে জানালো ফেসবুক খুললেই দেখা যায় অনেকেই আঁতেল হয়ে গেছে। সে তার ছেলের ফেসবুক খুললেই দেখে আঁতেল আঁতেল লেখা (এই যেমন আমি মাঝে মধ্যে উল্টা পাল্টা বিষয় নিয়ে উল্টা পাল্টা লিখি সেটাও নিশ্চয় ওর কাছে আঁতেলামি বলে মনে হয়)। কি কি বিষয় আছে আঁতেল লেখায় তা আর বিস্তারিত বললো না। তবে আমি অনুমান করি হয়ত কেউ কবিতা লেখে, কেউ প্রবন্ধ লেখে, কেউ স্মৃতিচারণ করে বা কেউ জ্ঞান বিজ্ঞান, চিকিৎসা বা কবিরাজি টোটকা ইত্যাদি যে বিষয়গুলো লেখে ওর ভাষায় আঁতেল পর্যায়ভূক্ত হতে পারে। ঠিক, অনেকেই এ কাজটি করে। এ দোষে আমিও কিছুটা দোষী। কারও মনে না চাইলেও ফেসবুকে ঢুকলে এ লেখার উপর চোখ চলে যায়। কখনও দু’চার লাইন ভুলে পড়াও হয়ে যায়। এটা নিশ্চয় সময় নষ্ট। অথচ এ সময়ে সুন্দর একটি ঘুম দেওয়া যেত বা টেলিফোনে আড্ডা দেওয়া যেত। এক্ষেত্রে আঁতলামি বিষয়ক আরও কিছু কমেন্ট বা অভিজ্ঞা বর্ননা করা যায়। যেমন একজন ফেসবুকে একটি কবিতা লিখেছেন। তাঁর বন্ধু তাতে কমেন্ট করেছে, “আরে এ যে দেখি নতুন কবির জন্ম হয়েছে”।
উত্তর অবশ্য তিনি ভাল দিয়েছেন, “কোন সমস্যা”। মোক্ষম উত্তর সন্দেহ নেই। ফেসবুকে কবিতা পড়ে আমাদের এক কলিগের উদ্দেশ্যে একদিন আরেক কলিগকে বলতে শুনলাম আরে, “তুমি যে কবি তাতো জানতাম না’। এক ফেসবুক বন্ধু আমার একটা লেখা পড়ে কমেন্ট করেছে, “তুমি প্রথম বাংলাদেশী যে বিজ্ঞান চর্চার জন্য এ বছর নোবেল পুরস্কার পেতে যাচ্ছে। অগ্রিম অভিনন্দন।” আরেক বেতমিজ পাবলিক(ফেসবুক বন্ধু নয়) লিখলো, “আপনাকে স্টিফেন্স হকিং এর চেয়ে কয়েকদফা উচ্চ স্তরের বিজ্ঞানী মনে হচ্ছে।” আঁতলামির এক উপযুক্ত পুরস্কার কি বলেন! এ রকম হাজারো উদাহরণ নিশ্চয় আছে। সুতরাং ওর বা আমার বয়সে আঁতলামি আর কাহাতকইবা ভাল লাগে। যাক, বন্ধুর সিদ্ধান্তকে সালামই জানাতে হয়। তবু রক্ষা বন্ধু ফেসবুকের বেশ কিছু জটিল ও আশ্চর্যজনক কমেন্ট এবং কার্যকলাপ তো দেখেনি। শুধু আঁতলামির কারনেই খামোশ হয়ে আছে। যেমন কোন লেখা পোস্ট হবার সংগে সংগে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লাইক চলে আসে। অথচ এমনিতে লেখাটি পড়তেই হয়ত কয়েক মিনিট লাগার কথা। আবার কখনও একজন হয়ত অন্যজনের ওয়ালে ঢুকে তার সকল পাবলিক পোস্টে (লেখার ক্ষেত্রে বিশেষ করে) দমাদম লাইক দিয়ে যাচ্ছে কোন প্রকার পড়ার ধার না ধেরেই। অথচ কিছু লিখলে সবাই আশা করে অন্যেরা পড়ুক। লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার আশা করলেও না পড়ে কেউ লাইক কমেন্ট করুক সেটা নিশ্চয় কেউ আশা করে না। না পড়ে কমেন্টের কয়েকটি উদাহরন দেওয়া যায়। যেমন কোন পোস্টের হয়ত শিরোনাম “আরও একটি নক্ষত্রের পতন কিন্তু ভিতরে খবর অবসরের।” এতে আত্মার শান্তি কামনা করে মন্তব্য। পাঠক পোস্টটি না পড়ে বেচারাকে মেরেই ফেললেন। তবে পোস্টের শিরোনামও নিশ্চয়ই যথাযথ হয়নি। এছাড়াও আছে লেখকের লেখা পছন্দ না হলে বা ভিন্নমতের হলে অশালীন মন্তব্য বা রীতিমত গালাগালির ছড়াছড়ি।
ইংরেজীর কমেন্টের যে বাহার তা বললে তো সাতখন্ড রামায়ণ হতে পারে। দু’টো উদাহরন দেই। “After I read it myself has been cry.” ও “It’s a excellent story. I was read it before.” যারা লিখেছেন তাদের একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে না কিন্তু। প্রোফাইলে ঢুকে দেখেছি তাদের রীতিমত কলেজ পড়া ডিগ্রী আছে। তা পাঠক কি বুঝলেন?
আরো আছে বিভিন্ন জেলার কৃতি সন্তানদের অভিনন্দন দেবার বহরের ছড়াছড়ি। গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রেও অবশ্য ফেসবুক এগিয়ে আছে। কোন ঘটনাকে পত্র পল্লবিত করে একেবারে মহীরুহ করে ফেলতে পারে। কখনওবা ঘটনাকে এমনভাবে সাজাবে যেন সেটাই সত্যি। আপনার জানা সত্যটা আপনার নিজের কাছেই মিথ্যা মনে হতে পারে। অথচ হয়ত সেটা সত্যের ধারে কাছেও নেই। কোন ছবি বা ভিডিও পরিবর্তন (ডক্টরিং বা ইঞ্জিনীয়ারিং) করে নতুন ছবি বা ভিডিও বানিয়ে ছড়াতে পারে। বীভৎসতা ছড়াতেও জুড়ি নেই। আছে এক ধরনের ধার্মিক যারা আপনাকে বলবে আপনি মুসলমান হলে “শেয়ার করুন বা লাইক দিন।” অথবা বলবে, “আমিন না লিখে যাবেন না’। বুঝুন ঠেলা। আপনি মুসলমান কিনা তা লাইক শেয়ার করে বা আমিন লিখে প্রমাণ দিতে হবে। আছে প্রচার প্রচারনার অবারিত সুযোগ। হোক না সে গোয়েবলসীয় প্রচারনা। কখনও বিনা কারনে ইতিহাস বিখ্যাত কোন ব্যক্তির ছবি বা কখনও ছোট্ট শিশুর প্রশংসনীয় কোন কাজ যেমন সুন্দর গলায় গান গাওয়া, ধর্মীয় কোন অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের ছবি দিয়ে আবদার করবে লাইক দিতে বা শেয়ার করতে। হয়ত বলবে, “জানি নায়ক নায়িকার ছবি হলে লাইক শেয়ারের অভাব হত না।”
অনেক সময় অপ্রাসংগিক কিন্তু মজাদার কিছু মন্তব্যও পাওয়া যাবে। যেমন স্মৃতিচারণমূলক কোন লেখা পড়ে কোন এক ফেসবুক বন্ধু হয়ত আপনাকে সততার সনদ দিয়ে দিতে পারে। স্মৃতি নিয়ে লেখার জন্য আপনি আবেগী অফিসার হতে পারেন কিন্তু সৎ অফিসার কিভাবে হবেন তা বোধে আসে না। অনেক সময় কেউ ক্যাপশন না দিয়ে হয়ত নিজের একক বা দলগত কোন ছবি বা প্রসংগ উল্লেখ না করে কোন বানী ( নিজের) পোস্ট দিয়ে দিল। এবারে এর মন্তব্যগুলো খেয়াল করবেন। দেখবেন মনে হবে যেন মহান কোন শিল্পীর আঁকা এ্যাবস্ট্রাক্ট কোন ছবি দেখেছে সবাই। যার যেমন প্রাসংগিক মনে হয়েছে সেভাবে মম্তব্য করেছে। ফেসবুক আপনাকে এমনি অসংখ্য ঋনাত্মক ও মজাদার বিষয় দ্বারা প্রভাবিত করতে পারে। আপনি ফেসবুকে আসক্ত হয়ে পড়তে পারেন। আসক্তি কিন্তু একটা রোগ।
এবারে ফেসবুকের ভাল কিছু বিষয়ের কথা বলা যাক যা বন্ধু হয়ত খেয়াল করেনি বা তার নজর এড়িয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলার বা স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রিয় বন্ধু বা বান্ধবীদের খুঁজে পেয়ে অতীত স্মৃতিচারণ বা বর্তমান জীবনের আনন্দ বেদনা ভাগাভাগি করা যায়। ছবি, ভিডিও বা লাইভে এসে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক আনন্দও ভাগাভাগি করা যায়। একা একা আনন্দ করার চেয়ে সবার সাথে ভাগাভাগি করলে আনন্দ বহুগুনে বেড়ে যায়। বিপদ আপদে বন্ধুদের পাশে দাঁড়াতে চান, আছে ফেসবুক। কোন বন্ধুর সাহায্য প্রয়োজন? ফেসবুকে একটা পোস্ট দিন দেখবেন অনেকে এগিয়ে আসবে।
কোন অপমানজনক, মর্মান্তিক বা হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে কিন্তু সংবাদপত্র, রেডিও বা টিভির প্রচারে আসেনি বা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ফেসবুকে পোস্ট করুন। দেখবেন জনমত সৃষ্টি হবে এবং সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আসবে। এর একটি বিহিত হয়েও যেতে পারে। আপনি অবসরপ্রাপ্ত চাকিরজীবি, আপনার যাবার বা সময় কাটানো জায়গা সংকুচিত, স্বজনরা সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। আপনার সোনালি অতীতের দিনগুলোর স্মৃতিচারণই আপনার ভরসা। একা একা স্মৃতিচারনে কোন মজা নেই। মজা পেতে চান বন্ধুদের সংগে ফেসবুকে ভাগাভাগি করুন। আপনি কোথাও অপেক্ষায় আছেন, আশে পাশে পরিচিত কেউ নেই। কোন চিন্তা নেই। ফেসবুক আছে আপনার সাথে। ফেসবুকে ঢুকুন আপনার সময় কখন শেষ হবে বুঝতেই পারবেন না। এধরনের আরও অনেক উদাহরন দেওয়া যাবে।
সবশেষে বলা যায় প্রবাদে যেমন বলা হয়, কচু কাটতে কাটতে কেউ একদিক গলা কাটা হয়ে যেতে পারে তেমনি আমার বন্ধুর ভাষায় ফেসবুকে লেখা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আঁতেলদের দু’একজন যে সত্যি সত্যি একদিন প্রকৃতই আঁতেল হয়ে উঠবে না তাই বা কে বলতে পারে। অতএব, আমার বন্ধুর মত যারা আছেন তারা ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিন আপনি শুধু আঁতেলের ভয়ে ফেসবুকে আপনার ফেস দেখানো থেকে বিরত থাকবেন কিনা?
লেখক : অতিরিক্ত ডিআইজি, নৌ পুলিশ, মিরপুর-১, ঢাকা।