দিল্লির কৃষক আন্দোলন ও বাংলাদেশ

প্রকাশিতঃ 10:47 am | December 08, 2020

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা :

ভারতের রাজধানী দিল্লির বুকে আজ হাজার হাজার কৃষক। নিজেদের ট্রাক্টর ও ট্রলিতে বেশ কয়েক মাসের খাবার নিয়ে, খোলা আকাশের নিচে তাঁবু খাটিয়ে শীতের রাত কাটানোর প্রস্তুতি নিয়ে দেশটির রাজধানীর ‘লাইফলাইন’ জাতীয় সড়ক এখন তাদের দখলে।

সম্প্রতি ভারতের পার্লামেন্টে পাস হওয়া তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে তারা এ আন্দোলন করছেন। ভারতের চাল-ডাল-গম-আলুসহ বেশকিছু কৃষিপণ্য এত দিন কোনো সংস্থা কিনে মজুত করতে পারত না। বিশেষ প্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে বিবেচ্য হতো। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের লোকসভায় এ বিশেষ প্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকা থেকে এগুলো বাদ দেওয়া হয়। ফলে ইচ্ছা করলে কোনো করপোরেট সংস্থা চাল-ডাল-গম-আলু কিনে মজুত করতে পারবে। এর বিরোধীয়েই বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেয় পাঞ্জাব, হরিয়ানাসহ ছয়টি রাজ্যের কৃষকরা।

অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশে তো কৃষকরা ঠিকই বঞ্চিত, কিন্তু এমন কৃষক আন্দোলন কেন হয় না? এর উত্তর অনেকে অনেকভাবে দেবে। আমি বলি, হয় না এ কারণে যে, আমাদের রাজনীতি কৃষককের জন্য নয়। সৃজনশীলতার জন্য কৃষকদের বাহবা দেওয়া যায়, তাদের জন্য কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণ করা যায়, কিন্তু তাদের জন্য কিছু করা যায় না। ভর্তুকি বা সুবিধা যা দেওয়া হয়, বছর শেষে খাঁটি কৃষকের পাওনা কেবল তার নিজের জন্য একটা গামছা আর লুঙ্গি, স্ত্রীর জন্য একটা অতি সাধারণ শাড়ি।

কৃষি হলো আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই করোনাকালেও প্রমাণ পাওয়া গেছে কৃষির শক্তি কতটা। যখন বেশিরভাগ শিল্প এবং সেবা খাত আত্মসমর্পণ করে বসেছে, বড় বড় শিল্পপতি ভিক্ষুকের মতো হাত পেতেছে, তখন একমাত্র কৃষিক্ষেত্রই মাথা তুলে থেকেছে। আমাদের কৃষক জিডিপি নিয়ে ভাবেনি, তাদের নিজস্ব আয় নিয়ে চিন্তা করেনি। তারা তাদের কর্মস্পৃহা আর উদ্যম দেখিয়ে গেছে।

বাংলাদেশের কৃষি এখনো অসংগঠিত। সংগঠিত আর্থিক ক্ষেত্র বলতে যা বোঝায়, বাংলাদেশের কৃষি তা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। বাজার অর্থনীতির যুগেও আমাদের কৃষিকে বাণিজ্যিকভাবে সংগঠিত করা যায়নি। সারাদেশে কৃষিপণ্য বিপণন এক বড় সমস্যা। প্রতি বছরই শুনতে হয় কৃষকরা উৎপাদিত পণ্যের দাম পাচ্ছে না। রাস্তায় দুধ ফেলে দেয়া, সবজি ছুড়ে ফেলাসহ কৃষকের কান্না করার দৃশ্য আমাদের বহু চেনা। সুযোগটা নিতে শুরু করেছে কিছু কিছু কোম্পানি। কৃষি উৎপাদনের বিপণনের বিপুল অংশই চলে যাচ্ছে এসব প্রাইভেট কোম্পানির হাতে।

প্রতিক্রিয়াধর্মী কিছু সিদ্ধান্ত হয় মাঝে মাঝে। চাল, পেঁয়াজ বা আলুর দাম বাড়লে সরকার দাম নির্ধারণ করে। কিন্তু বাজারে তার কোনো প্রভাব ফেলে না। কৃষকের জন্যও এসব ব্যবস্থা কোন প্রভাব রাখে না। কৃষিতে করপোরেট বিনিয়োগ হচ্ছে সার, বীজ, পেস্টিসাইডসসহ নানা উপকরণে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কৃষিপণ্যের কোনো করপোরেট বিপণন কাঠামো গড়ে ওঠেনি। ফলে জেলায় জেলায় কৃষিপণ্যের কোন সংগঠিত বাজার নেই। আছে কেবল কৃষক ঠকানোর মধ্যস্বত্বভোগী সামন্ত ব্যবস্থা। স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে চলল। আজ পর্যন্ত কৃষিপণ্যের প্রায় পুরোটাই যাচ্ছে এই মধ্যস্বত্বভোগীদের ঘরে; যারা আবার রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান। কৃষিপণ্য বিপণনের কোন সংগঠিত বেসরকারি ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি।

আমাদের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো মাথাব্যথা নেই কৃষকদের নিয়ে। জমি দখল যেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সেখানে কৃষক আর কৃষির জন্য কোন রাজনীতি থাকে না। একটা প্রশ্ন করা যেতে পারে– কৃষকের আয় কত? তাদের আসলে কোনো আয় নেই। সত্যিকারের কৃষকরা প্রান্তিক হলেও ধনী কৃষকও আছেন অনেক। এদের অনেকে আবার দ্বৈত নাগরিক। এই ধনী কৃষকরা কেউ এমপি, মন্ত্রী বা সরকারি-বেসরকারি রাজনীতিক।

কৃষকের কাছে এই পরিস্থিতি তুলে ধরার মতো রাজনীতি নেই, দল নেই, সংগঠন নেই। অত্যন্ত অংসগঠিতভাবে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের কৃষিই আজ কৃষির বড় সঙ্কটে। সরকার সেচ ও সার সুবিধা দেয়। কিন্তু এর বড় সুবিধা পায় দখলবাজ বড়লোক কৃষকরা।

প্রথম কথা হলো বাংলাদেশের কৃষিকে আমরা কি চাইব এই সুবিধাবাদ আর ক্ষমতার রাজনীতি করা বড় কৃষকদের হাত থেকে মুক্ত হোক? কিংবা আমরা কি চাইব কৃষিকে অপহরণ করুক করপোরেট খাত? দুটোর কোনোটাই কৃষি ও কৃষকের উপকারে আসবে না, যা হবে সেটা হলো, দেশের গ্রামগুলো পরিণত হবে করপোরেট বাণিজ্যিকীকরণের কেন্দ্রভূমিতে।

কৃষি ছেড়ে দিচ্ছেন আজ অনেকেই। ধান কাটার লোক পাওয়া যায় না। এটি কৃষির সঙ্কট, কৃষকের সঙ্কট, দেশের সঙ্কট। আমাদের কৃষকরা তাদের কষ্টার্জিত পণ্যের দাম পায় না। কিন্তু আমাদের মনোজগতে এর কোনো প্রভাব পড়ে না। এটা নৈতিকতার সঙ্কট, কৃষি অর্থনীতির কাঠামোগত সঙ্কট।

এই যখন অবস্থা তখন কৃষি আন্দোলন হবে কি করে? কৃষকের আয় এত কম যে, তা কোনো আলোচনায়ই আসে না। তাদের জন্য কোনো শ্রম আইন সুবিধাও নেই। নয়া উদারনীতি আর বাজারেও তাদের ঠায় নেই। কৃষি সংস্কার হোক। তবে প্রত্যাশা থাকুক মধ্যস্বত্বভোগীদের স্থলে, কৃষি এবং কৃষক দরদের আড়ালে যেন করপোরেটদের স্বার্থ সুরক্ষিত না হয়।

কালের আলো/ডিএসবি/এমএম