অন্যায়ের প্রতিকার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার নিরন্তর প্রয়াস ছিল তাদের

প্রকাশিতঃ 11:13 am | November 28, 2020

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা :

বাংলাদেশের থিয়েটার আন্দোলনের পথিকৃত, নাট্যব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা আলী যাকের চলে গেলেন গতকাল। দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারে ভুগে করোনায় আত্মসমর্পণ করলেন সংস্কৃতি অঙ্গনে সবার প্রিয় ছোটলু ভাই। এর আগে দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের পরিচালক আলমগীর হোসেনও আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। একসপ্তাহে এতগুলো মৃত্যু মেনে নেয়া কঠিন।

কিন্তু মেনে নিতে হয়। আলমগীর হোসেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না, কিন্তু সংস্কৃতিসেবী মানুষ ছিলেন। আলী যাকের আর মুনীরুজ্জামান- দুজনই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মী ছিলেন এবং সেই পথ ধরেই নিজেদের মেলে ধরেছিলেন সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার অসীম দিগন্তে।

এই করোনাকালে অসংখ্য চিকিৎসক, সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিত্ব, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হারিয়েছি। আমরা হারিয়েছি কামাল লোহানীকে, রাহাত খানকে, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে। তারা সবাই অনন্তের পাখি হয়ে কোথায় চলে গেলেন জানি না। তারা এমন একসময় মারা গেলেন যখন দেশে তাদের প্রয়োজন বড় বেশি ছিল। আজ অন্ধকারের শক্তি, সাম্প্রদায়িকচক্র ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছে সেই পাকিস্তানিদের মতো।

কামাল লোহানী, রাহাত খান, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, আলী যাকের, খন্দকার মুনীরুজ্জামানরা বারবার সহিষ্ণুতার পক্ষে, হিংসার বিরুদ্ধে, অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় সম্প্রতি বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতার পথেই চলবে বাংলাদেশ। কোনো সাম্প্রদায়িক উসকানিকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেয়া হবে না, এ কথাটি জানিয়ে তিনি একটি মৌলিক দায়িত্বের কথাই সবাইকে মনে করিয়ে দিলেন। এখানে কোনো আলাদা রাজনীতি নেই। এটাই আপামর বাঙালির রাজনীতি যা ১৯৭১-এ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেই নির্ধারিত হয়ে গেছে।

দেশজুড়ে উগ্র মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর যে রাজনীতি হুঙ্কার চলছে, সে আগুনকে ছড়াতে না দেয়াই শাসকদল ও সরকারের কর্তব্য। সম্প্রতি এবং সাম্প্রতিক অতীতে গোটা দেশেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বেড়েছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কতটা মারাত্মক, তার প্রমাণ দেশে দেশে দেখেছি এবং দেখছি আমরা। মসজিদের ভেতর পুড়িয়ে, পিটিয়ে মারা, হিন্দু বাড়ি-ঘরে আক্রমণের পর এবার শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরুদ্ধে হুঙ্কার। আমরা মনে করি এদের বাড়তে দেয়ার ঝুঁকি না নেয়া প্রশাসনিক বিচক্ষণতার পরিচয়।

অস্থির সময়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখবার ঐতিহ্য আমাদের আছে। তার অগ্রভাগে ছিলেন কামাল লোহানী, আলি যাকের, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, খন্দকার মুনীরুজ্জামানরা। তারা বারবার জীবদ্দশায় পথে নেমেছেন, কলম ধরেছেন, রাজপথে স্লোগান দিয়েছেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বার্তা দিয়েছেন যে, মানুষের সাথে মানুষের সম্প্রীতিতে ধর্ম কখনও বাধা হতে পারে না। বর্তমান বাংলাদেশে কাজটি আরও কঠিন, কারণ দাঙ্গার দাউদাউ আগুন না থাকলেও উগ্র জঙ্গি মতাদর্শের তুষের আগুন যেন তৈরি করেছে এক গোষ্ঠী। এদের ঠেকাতে হবে।

এই মানুষগুলোর এ রকম অসংখ্য প্রগতিশীল মানুষের জীবনবোধের মূলকথাই ছিল পরাজয় স্বীকার না করা। তারা যুদ্ধ করেছেন রণাঙ্গনে, ফিরে এসে জাতি গঠনে, সমাজকে আলোকিত করতে। বয়স আর অসুখের কাছে তাদের পরাজিত হতেই হয়েছে, কিন্তু তাদের আদর্শের মৃত্যু হয়নি।

ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন দেশে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ- সবকিছুর লক্ষ্য বাংলাদেশ চলবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যার মর্মার্থ ছিল উদার ও অসাম্পাদ্রায়িক সমাজ।

আমাদের ভাষা আন্দোলন ছিল একটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়। ওই আন্দোলনের ফলে সাম্প্রদায়িক মুসলিম জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে পূর্ববাংলার মানুষ। ভাষা আন্দোলন ছিল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। সেই পথ ধরেই মুক্তিযুদ্ধ। তাহলে আজ কোন শক্তি আবার দেশকে পাকিস্তানি আদর্শে ফিরিয়ে নিতে চায়?

করোনাকালে আমাদের অনেক আলোকিত মানুষ চলে গেছেন। তারা বিশ্বাস করতেন সংঘাত হোক যুক্তির, কিন্তু পেশীর নয়। আমাদের শাসনপ্রণালীর ভেতর কোনো গলদের কারণে যদি অন্ধকারের জীব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তবে তার প্রতিবাদ করবে বুদ্ধিজীবী, সমালোচক ও চিন্তাবিদরাই। এই মানুষগুলো আমাদের বলে গেছেন, প্রবাহমান সময় থেকে এই বুদ্ধিজীবীরা চোখ সরিয়ে নিতে পারেন না। বুদ্ধিজীবিতার খাতিরে ভুলে থাকা যায় না সমাজের সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্ব।

তাদের দেখানো পথে যেন চলি আমরা। অন্যায়ের প্রতিকার এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার নিরন্তর প্রয়াস ছিল তাদের। আমরা যেন বর্তমান সময়ের অনিশ্চয়তাকে অনুধাবন করে সমাজের গতিশীলতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেদের গতিশীল করতে পারি। তবেই জানানো হবে তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি