উন্মত্ততা

প্রকাশিতঃ 10:53 am | November 01, 2020

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:

কিছু উন্মত্ত মানুষ, সম্মিলিত হয়ে একটি মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করে সমবেত ভাবে হত্যা করল, পুড়িয়েও মারল। মনে আছে নিশ্চয়ই আমাদের গত বছরের কথা। একের পর এক গণপিটুনির ঘটনা। আমাদের নাগরিক মনকে নাড়া দিয়েছিল বাড্ডার তাসলিমা বেগম রেনুর হত্যার ঘটনা। গত বছরের ২০ জুলাই সকালে উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাসলিমা তাঁর চার বছরের মেয়েকে ভর্তি করানোর বিষয়ে খোঁজ নিতে যান। সেখানে উপস্থিত কয়েকজন নারী তাঁকে ছেলেধরা সন্দেহ করে এবং কিছু উচ্ছৃঙ্খল মানুষ তাকে পিটিয়ে হত্যা করে।

লালমনিরহাটে ধর্ম অবমাননা কিংবা বাড্ডায় ছেলে ধরা – কোনটাই প্রমাণিত নয়। কিংবা হলেও দেশে যে আইন আছে, বিচার আছে তার কোন বিবেচনা নেই। কিছু মানুষ একটা জনাদেশ দিয়ে উপস্থিত মানুষকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে হত্যা করল এদের। জনতাকে এমন উন্মত্ত যারা করে তাদের বিচার হয় না। আর সম্মিলিত মানুষের সমষ্টি কোন অন্যায় করলে তারা চিহ্নিত হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গণপিটুনির শিকার হন দুর্বল, অসহায় মানুষ। তাদের মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীন, নারী, শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধীই বেশি। লালমনিরহাটের ভিক্টিমও কিছুটা হতাশ ও মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন বলে খবর আসছে। চোর সন্দেহে, ছেলে ধরা সন্দেহে গণপিটুনির পর এবার পবিত্র কোরআন অবমাননা। শুধু পিটিয়ে মৃত্যু নয়, লাশ পুড়িয়েও দিয়েছে সেই খুনিরা। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এই নিহত মানুষগুলির মধ্যে খুব কম সংখ্যক মানুষ অপরাধ কর্মের সঙ্গে জড়িত, বেশিরভাগই হয়তো নিরাপরাধ।

এই খবরগুলি খুব বেশি গা সওয়া করে ফেলছি আমরা। গোরা মৌলবাদিরা নানাভাবে হত্যার পক্ষে যুক্তি দেখাবে। কিন্তু আমরা সামাজিক মাধ্যমে দেখছি এক শ্রেণির সুশীলও বলছে, ‘পিটিয়ে মারা ইসলাম সমর্থন করে না, তবে ধর্ম অবমাননা করাও জঘন্য অপরাধ’। এভাবে হত্যার পক্ষে নাগরিক বয়ান সৃষ্টি করে তারা ফেসবুকে, ইউটিউবে এক শ্রেণির লোক ধর্মের নামে উন্মাদনা ছড়াচ্ছে। সামগ্রিকভাবেও আমরা দেখছি কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর এমন প্রচেষ্টা। সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে তাতিয়ে দিয়ে এরা সমাজে অস্থিরতা জিইয়ে রাখতে চায় নিজেদের ফায়দার জন্য। কোথায় ফ্রান্সে ঘটেছে ঘটনা, উন্মাদনা তৈরির চেষ্টা বাংলাদেশে। ধর্মকে সামনে রেখে যারা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন করে তারা সুযোগ নিতে চায় পরিস্থিতির।

গুজব, কুসংস্কার আর ধর্ম ব্যবসায়ীদের পাল্লায় পড়ে অনেকেই বুঝতের পারেনা যে কি কাজ তারা করছে। গুজব ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করে ও সেই আতঙ্ক থেকেই গণপিটুনির ঘটনাগুলি ঘটে। ছেলেধরা গুজবে বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কারণেও গণপিটুনির শিকার হয়েছেন অনেকে। সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া ও পিটিয়ে হত্যা করা এক ভয়ংকর অপরাধ। ধর্ম রক্ষার জন্য গণপিটুনি ঘটলে বিচারের পথও রুদ্ধ হয়ে যায়। বিষয়টা এত স্পর্শকাতর যে পুলিশও খুব সক্রিয় হতে সংশয়ী হয় এগুলোর অনুসন্ধানে। সম্মিলিত হত্যাকারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শাস্তি পায় না। খুনিকে চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে প্রায়। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টিও সবার জানা।

মানুষ যে এমন হিংস্র ও নির্মম হয়ে উঠেছে, এর নিশ্চয়ই কারণ আছে। কেন তুচ্ছ কারণে একটি অসহায় দুর্বল মানুষকে বেঁধে পিটিয়ে মারছে একদল মানুষ, তার নেপথ্যে কি মনস্তত্ত্ব কাজ করে সেটা সমাজ বিজ্ঞানীদের বিষয়। কিন্তু বিচার হতে হবে। এই প্রযুক্তির যুগে কোন ঘটনাকেই আড়াল করা সম্ভব না। কারা ঘটনার সময় ছিল, কারা আদেশ নির্দেশ দিয়েছে, কারা সেগুলো বাস্তবায়ন করেছে সবই বের করা সম্ভব।

একজন মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেওয়ার অধিকার কাউকে দেয়নি রাষ্ট্র, তারা যত বড় কামেল লোকই হোন না কেন। হত্যা হত্যাই, ফৌজদারি অপরাধ। এক জন মারলেও হত্যা, দশ জন মিলে মারলেও হত্যা। এই ফৌজদারি অপরাধকে হাল্কা করে দেখার অবকাশ নেই যত স্পর্শকাতরই হোক না কেন।

নাগরিক সমাজের মন আজ ভারাক্রান্ত। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের এই হাল দেখে এর ভবিষ্যত নিয়ে সবাই চিন্তিত। হা হুতাশ করে, দুঃখজনক শব্দ উচ্চারণ করে ঘটনা সমূহকে এড়িয়ে যাওয়া আর যাচ্ছে না। গুজব ছড়ানো ও গণপিটুনি রোধে গত বছর পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছিল হাইকোর্ট। সেগুলোর চারটি ছিল ১. পুলিশের প্রত্যেক সার্কেল অফিসার(এএসপি) তার অধীনের প্রতিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সাথে ৬ মাসে অন্তত একবার গণপিটুনি প্রবণতার বর্তমান অবস্থা নিয়ে বৈঠক করবেন, ২. গণপিটুনির বিরুদ্ধে সচেনতা তৈরির লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার প্রচার কার্যক্রম ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে প্রচারণা অব্যাহত রাখবেন। ৩. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেকোনও ধরনের অডিও, ভিডিও, খুদে বার্তা যা গুজব সৃষ্টি বা গণপিটুনিতে মানুষকে উত্তেজিত করতে পারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। যে দুষ্কৃতকারীরা এ কাজে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ৪. যখনই গণপিটুনির কোন ঘটনা ঘটবে কোন রকম দেরি না করে তখনই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এফআইআর নিতে বাধ্য থাকবে এবং তা সংশ্লিষ্ট পুলিশ সুপারকে অবহিত করবেন।

উচ্চ আদালতের এসব নির্দেশনার বাস্তবায়ন দেখতে চাই আমরা। এই নৃশংস আচরণ আর বরদাশত করা যায় না। সংক্রামক হওয়ার আগেই ঠেকাতে হবে এই ব্যাধি। আইন হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কোন ব্যক্তির নেই, কোন গোষ্ঠীরও নেই। নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকার দিন শেষ। গণপিটুনির বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ যেমন প্রয়োজন, তেমনি দরকার গুজবের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি করা এবং গণপিটুনিতে অংশগ্রহণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।

কালের আলো/বিএমএফ/এসবি