শেখ রেহানা: নিভৃতচারী এক ভগিনী

প্রকাশিতঃ 5:41 pm | September 13, 2020

অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ:

শেখ রেহানা; জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেভাবে তাঁর উপস্থিতি লক্ষ্য করা না গেলেও আড়ালে থেকে অনুপ্রেরণাদায়ী হিসেবে রয়েছেন তিনি। বাঙলার মানুষের এক নিভৃতচারী ভগিনী। সুখে-দুখে নীরবে পাশে থেকে উপকার চলেন এই মহৎ মানুষটি।

তাঁর সাদামাটা জীবনাচরণ ও অতিথিপরায়ণতায় সবাই মুগ্ধ। নীরবে নিবৃত্তে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, সংগ্রাম করে যাচ্ছেন জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে। সুযোগ্য মায়ের যোগ্য উত্তরসূরী শেখ রেহানা, মা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পর্দার অন্তরালে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিলেন সাহস ও অনুপ্রেরণা যার ফলশ্রুতিতে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হতে পেরেছিলেন।

আর এখানে শেখ রেহানার ভূমিকা আরও সুস্পষ্ট, বোন শেখ হাসিনা আজ বিশ্ব নেতৃত্বের উজ্জ্বল নক্ষত্র। এর পেছনে নিঃসন্দেহে বোন শেখ রেহানার ভূমিকা রয়েছে। এই প্রেরণাদায়ী শেখ রেহানার জন্মদিন ১৩ সেপ্টেম্বর। জন্মদিনে তাঁর প্রতি রইলো শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা।

১৯৫৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বেড়ে ওঠা গ্রামেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছাসহ পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করে। সে সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি ছিলেন জার্মানি। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন।

দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও কখনও সক্রিয় রাজনীতির সামনের সারিতে আসেননি শেখ রেহানা। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ সক্রিয় রাজনীতিবিদদের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা দিয়ে গেছেন তিনি। জনহিতৈষী কাজে সব সময়ই ভূমিকা রেখেছেন।

ধানমন্ডিতে তাঁর নামে বরাদ্দ বাড়িটিও দিয়েছেন দেশের কাজে। বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা, সবার কাছে ‘ছোট আপা’ হিসিবে পরিচিত। অধ্যাপক ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিক ও শেখ রেহানা দম্পতির তিন ছেলে-মেয়ে। তাদের মধ্যে বড় মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লেবার পার্টির একজন এমপি।
ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত। আর ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক লন্ডনে কন্ট্রোল রিস্কস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের গ্লোবাল রিস্ক অ্যানালাইসিস সম্পাদক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাতির জনক হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে তাঁর ‘প্রিয় রেণু’র অসামান্য ভূমিকা। যা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বারবার উল্লেখ করেছেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু জীবিত থাকাবস্থায় কখনও শেখ ফজিলাতুন্নেছাকে ফ্রন্টলাইনে দেখা যায়নি। আড়ালে থেকে নিজের কাজটাই ঠিক মতো করে গেছেন বাঙালির স্বপ্ন জয়ের এই সারথী।

ইতিহাসেও আমরা দেখতে পাই, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায় করতে গিয়ে জীবনের বেশির ভাগ সময় জেলে কাটিয়েছেন। এ অবস্থায় শেখ ফজিলাতুন্নেছা দল ও দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ও পরামর্শে।

শেখ রেহানাও তাঁর বোন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতির বিপদসংকুল দিনগুলোতে আগলে রাখেন এবং সঠিক পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন। এভাবেই নীরবে, নিভৃতে মানুষের কল্যাণে কাজ করে চলেছেন তিনি।

থাকাকালে শেখ রেহানার বিয়ে হয় লন্ডনে, ওই সময় তাঁর স্বামী অধ্যাপক ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিক ইংল্যান্ডে উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়ন করছিলেন। কিন্তু একমাত্র বোনের বিয়েতে শেখ হাসিনা ছিলেন অনুপস্থিত।
এ প্রসঙ্গে শফিক সিদ্দিক লিখেছেন, ‘‘৮৩ সালে তখন হাসিনা আপা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে ঢাকায় অবস্থান করছেন। ঐ সময়ে আমি আমার পিএইচডি থিসিসের কাজে ঢাকা গিয়েছিলাম। একদিন হাসিনা আপার বাসায় উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলাম, উনি হাশেম ভূঁইয়া নামের একজন কর্মীর অসুস্থ মেয়েকে লন্ডন পাঠাবার ব্যবস্থা করছেন। তখন হাসিনা আপা বেশ দুঃখ করে আমাকে বললেন, ‘শফিক দেখ, আজকে আল্লাহর ইচ্ছায় আমি আমার একজন কর্মীর অসুস্থ মেয়েকে বিদেশ পাঠাতে সাহায্য করতে পারি। কিন্তু সেদিন আমার একমাত্র বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে দিল্লি থেকে লন্ডন যেতে পারিনি, কেবল টিকেটের টাকার অভাবে।”

বাবা-মা হারা, অভিভাবক বলতে বড় বোন শেখ হাসিনা। অথচ তিনি-ই থাকতে পারলেন না ছোটবোনের বিয়েতে। এটা বেশ দুঃখজনক ও যন্ত্রণাদায়কও বটে। তবে বাবা-মায়ের অভাব তারা দেশের মানুষের কাছেই খুঁজে ফেরেন। এখন দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটছে। তাঁদের পারিবারিক শিক্ষা, বিশেষ করে মায়ের দেয়া শিক্ষা তাঁদের দুইবোনকে ধৈর্য, সাহস, বিচক্ষণতা, অধ‍্যাবসায়, ত‍্যাগ, নির্লোভতা চলার পথকে সুগম করেছে। বিজয়ী করেছে।

বিয়ের পর লন্ডনে জীবিকা নির্বাহের জন্য চাকরিও করেন শেখ রেহানা। সেখানেই জন্ম হয় ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও বড়মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকের। ছোট মেয়ে রূপন্তির জন্ম ব্রুনাইয়ে।

একপর্যায়ে বিদেশের মাটিতেই পিতৃ হত্যার বিচার চাইলেন শেখ রেহানা। ১৯৭৯ সালের ১০ই মে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে অনুষ্ঠিত সর্ব ইউরোপীয় বাকশালের সম্মেলনে বড়বোন শেখ হাসিনার প্রতিনিধি হয়ে যোগ দেন তিনি। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অত‍্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে উত্থাপন করেন, ১৫ আগস্ট নারকীয় হত‍্যাকাণ্ডের বিচার দাবি।

স্টকহোম থেকে ফিরে স্বামী শফিক সিদ্দিককে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ।‌ সভাপতি করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী স‍্যার টমাস উইলিয়াম কিউসি এমপিকে। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পিত হয় জাতীয় চার নেতার অন‍্যতম ক‍্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীর বড়ছেলে ড. মোহাম্মদ সেলিমের ওপর।

সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও বঙ্গবন্ধু হত্যা তদন্তে আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনে শেখ রেহানা অন‍্যতম মুখ‍্য ভূমিকা পালন করলেও তিনি আড়ালেই থেকে যান এবং এখনও তিনি আড়ালে থেকেই শেখ হাসিনার পাশাপাশি সবক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।

জন্মদিনে বহুমুখী গুণের অধিকারী, মানবিক মানুষ শেখ রেহানাকে অভিনন্দন।শুভ জন্মদিন।

লেখক: উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; মেলান্দহ, জামালপুর।

Print Friendly, PDF & Email