কোরবানিতে করোনার সংক্রমণ ও অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রভাব এড়াতে করণীয়

প্রকাশিতঃ 9:10 am | July 19, 2020

অধ্যাপক ডক্টর মোঃ সাইদুর রহমান:

বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। প্রায় ১৭ কোটি জনতাকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে পারলে বাংলাদেশ সবচেয়ে সম্পদশালী রাষ্ট্রে পরিণত হতো। এ জন্য প্রয়োজন গুণগত মানের শিক্ষার প্রসার, প্রযুক্তিগত জ্ঞানের উন্নয়ন এবং হাতে কলমে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদারকরণ। বর্তমান সরকারের কার্যকরি পদক্ষেপ অব্যাহত ছিল কিন্তু কোভিড-১৯ প্রাণঘাতি মহামারী এসে ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জনবহুল এদেশটির অর্থনীতিকে এলামেলো করে দিল। জীবন-জীবিকা উভয়ই সচল রাখতে সরকার বদ্ধপরিকর।

উদ্দেশ্য হলো করোনা মহামারীকে যতটা সম্ভব মোকাবেলা করা। করোনা মোকাবেলা করার পথে আমাদের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্ছ হলো আসন্ন ঈদ-উল-আযহার সময়কালে সুষ্ঠুভাবে গরু-মহিষ-ছাগল-ভেড়া কোরবানি করা। গ্রামের মানুষের নিকট সবচেয়ে প্রাচীন কিšদ সহজে আয়ত্ব করা কৃষিব্যবসা (এগ্রিবিজনেস) হলো কোরবানি উপলক্ষে গরু-ছাগল মোটা-তাজাকরণ এবং অপেক্ষাকৃত বেশি দামে বিক্রি করে সংসারের সবাইকে নিয়ে ঈদ উদ্যাপন করা এবং বছরের বাকি সময়টাতে ব্যয় নির্বাহের জন্য কিছুটা আয় হাতে রাখা।

করোনায় কৃষি কম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কিন্তু করোনার প্রভাব কৃষিতে প্রতিনিয়ত আঘাত হানছে। গ্রাম বাংলার মানুষ করোনায় বাড়িতে আবদ্ধ থেকে অন্যান্য কাজ কর্ম করতে বাইরে না গিয়ে অত্যন্ত যত্নসহকারে একটি/দুটি গরু এবং ছাগল-ভেড়া লালন-পালন করে আশায় আছে কোরবানিতে ভাল দামে বিক্রি করবে। তবে করোনায় সংক্রমণের হার কমাতে অতিমাত্রায় স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করায় কোরবানির ক্ষেত্রে কিছুটা ভাটার আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মোতাবেক দেশে কোরবানির চাহিদা রয়েছে ১ কোটি ১০ লক্ষ আর সরবরাহ হবে প্রায় ১ কোটি ১৯ লক্ষ বা তার বেশি। করোনার কারণে মানুষ কোরবানি করতে অপেক্ষাকৃত কম উৎসাহীত হওয়ার আশঙ্কা সত্য হলে খামারীরা এবং ব্যক্তি পর্যায়ের কম আয়ের মানুষ চরম ক্ষতির মুখে পরবে।

অর্থনৈতিক ক্ষতি এড়াতে প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে :
১। মানুষের আয় বাড়লে গ্রাম-শহর উভয় জায়গায়ই মানুষ ধর্মীয় বিষয় মাথায় রেখে প্রতিযোগিতা করে বেশি বেশি কোরবানি করে থাকে যার সুবিধাভোগী হয় গ্রামের কম আয়ের মানুষ। এছাড়া আয় বাড়লে কয়েকজনে মিলে বড় গরু কোরবানি দেয় এতেও বাজারে গরুর চাহিদা বেশি থাকে ফলে দাম বৃদ্ধির সুবিধা পায় কোরবানির পশু লালন-পালনকারী কম আয়ের মানুষ। করোনার প্রভাব উল্লেখিত দুটো ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলবে কিন্তু যারা কোরবানি দিবেন তারা বিষয়টি বিবেচনায় রাখলে ক্ষতিকর এ প্রভাব কিছুটা কমানো সম্ভব হবে।

২। প্রত্যেকটি জায়গায় স্থানীয় শিক্ষিত যুবকরা এগিয়ে আসলে কোরবানির পশু অনলাইনে বেচাকেনা করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এছাড়া প্রাণী চিকিৎসকদের প্রদত্ত ফর্মুলা ব্যবহার করে গরু-মহিষের মোট ওজন ক্যালকুলেশন করে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণের মাধ্যমে গরু বেচাকেনার পদ্ধতি চালু করা দরকার। তাহলে সহজেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্রেতা এবং বিক্রেতারা তাদের নির্ধারিত কাজ শেষ করতে পারবে।

৩। কোরবানিতে পশু কোরবানি কম হলে কম আয়ের মানুষ কম মাংস পাবে ফলে প্রাণিজ প্রোটিনের ঘাটতি বাড়বে। করোনা মোকাবেলায় প্রাণিজ প্রোটিনের ঘাটতি পূরণে সমাজের অপেক্ষাকৃত ধনী শ্রেণীর মানুষরা বেশি করে কুরবানী করতে এগিয়ে আসবে এটাই কাম্য।

৪। গরু-মহিষ-ছাগল-ভেড়া ট্রাকে বহন করার সময় কিছুসংখ্যক লোক রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে, ট্রেড ইউনিয়নের নামে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু ব্যক্তি জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করে থাকে যার নেতিবাচক প্রভাব চুইয়ে পড়ে খামারীর আয়ের উপর। করোনার সময় এসব চাঁদা তোলার বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারী বাড়াতে হবে।

৫। কোরবানির পশুর হাট ইজারা পাবার জন্য দৌঁড়-ঝাপ করা একটি মহলের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এ ইজারা দেয়া হয়। এতে সরকারের কোষাগারে যে রাজস্ব জমা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি আয় করে রাজনৈতিকভাবে স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তিরা। করোনাকে সামনে রেখে এসব অনৈতিক চর্চা বন্ধ করলে কোরবানির পশু পালনকারী কম আয়ের মানুষের উপর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে ।

৬। করোনার কারণে মানবিক লকডাউন থাকায় হোটেল-রেঁস্তোরা বন্ধ ছিল। সেকারণে কোরবানি উপলক্ষ্যে গরু-ছাগলের সরবরাহ বেড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তাই করোনায় গ্রামের কম আয়ের মানুষদেরকে সহায়তা করার জন্য সমাজের সামর্থবান মানুষদের বেশি করে কোরবানি দিতে এগিয়ে আসতে হবে এবং সরকারের পাশাপাশি প্রচার মাধ্যমের কাজ হবে তাঁদেরকে উদ্বুদ্ধ করা।

৭। করোনার সময়ে যারা কোরবানি দিবেন তাদের প্রতি আহবান হলো প্রতি বছরের ন্যায় এবারও কোরবানি দেয়া অন্যদিকে যারা কোরবানির পশু বিক্রি করবেন তাদের প্রতি অনুরোধ হলো বেশি লাভের আশা না করে বাজার অনুসারে দাম পেলেই যেন বিক্রি করে দেন। কোনো কারণে কোরবানির সময়ে পশু বিক্রি করতে ব্যর্থ হলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং চরম ভোগান্তির আশঙ্কা থাকবে।

৮। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সঠিকভাবে মানলে কোরবানির পশু কিনতে তেমন কোনো অসুবিধা হবে না। এজন্য শহর থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত সকল হাট-বাজারের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব মানতে বাধ্য করতে হবে এবং হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এছাড়া হাওর ও বন্যা কবলিত নিম্নাঞ্চলের মানুষের কোরবানির পশু বাজারজাতকরণে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এগিয়ে আসতে হবে।

৯। সাধারণভাবে কোরবানির সময় যারা পশু কেনাবেচা, জবাই, কাটাকাটি এবং ভাগাভাগিতে সহযোগিতা করে তাদের স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করাটা বেশি জরুরি। এজন্য যথাসম্ভব পরিচিতজনদের দিয়ে উক্ত কাজগুলো সম্পন্ন করা উচিৎ। সম্ভব হলে নিজেরাই কোরবানির সকল আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করতে পারলে আরো ভাল হয় তবে এক্ষেত্রে পরিবারের শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিদের দূরে রাখতে হবে।। পশু কোরবানির আবর্জনা ও বর্জ্য গর্ত করে মাটিতে পুতে রাখা এবং পশু কোরবানির স্থান পানি দিয়ে অত্যন্ত সুন্দরভাবে পরিষ্কার করে সেখানে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে রাখা যাতে কোন প্রকার দুর্গন্ধ না ছড়ায় এবং আশেপাশের পরিবেশ নষ্ট করতে না পারে।

১০। তিন দিনব্যাপী কোরবানি করার ধর্মীয় বিধান থাকলেও গ্রাম ও শহরের লোকজন সাধারণতঃ একদিনেই কোরবানি করে থাকে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তিন দিনে বিভক্ত হয়ে কোরবানি করলে করোনায় সংক্রমণ ঝুঁকি কমে আসবে। করোনার কারণে প্রচলিত আচার আচরণের বাইরে কিছু কিছু পরিবর্তন গ্রহণ করতে আমাদের অভ্যস্থ হতে হবে।

১১। গ্রামে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করে। অনেক গ্রামে কোরবানির সকল পশু এক জায়গায় এনে কোরবানি করা হয় এবং সবাই মিলে মাংস ভাগাভাগি করে এবং বিতরণ করে থাকে। করোনার কারণে এ বছর আলাদা জায়গায় কোরবানি করা উচিৎ হবে। গ্রামের কারা মাংস পাবার আশায় থাকবে তা সকলের জানা। পূর্বে ঘোষণা দিয়ে সমাজের ঐ সমস্ত মানুষদের নিকট মাংস পৌঁছিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে করোনা সংক্রমণ কম হওয়ার পরিবেশ তৈরি হবে।

১২। কোরবানিতে গরু-ছাগল কেনা-বেচায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রচারিত বিজ্ঞানটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং প্রয়োজনের নীরিক্ষে করা হয়েছে। এধরনের আরও বিজ্ঞাপন তৈরি করা এবং বেশি বেশি প্রচার করা জরুরি। আশা করি তথ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিবে।

১৩। বিগত কয়েক বছরের ন্যায় এবারও যেন গরু-মহিষ প¦ার্শবর্তী দেশ থেকে আমদানি বা চোরাই পথে প্রবেশ করে দেশে উৎপাদিত কোরবানির পশুর বাজার মূল্যকে প্রভাবিত করতে না পারে সেদিকে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি রাখতে হবে।

১৪। চামড়া ব্যবসায়ীরা যাতে কোনো ধরনের সিন্ডিকেট করে কৃত্রিমভাবে বাজারকে প্রভাবিত করে চামড়ার দাম কমিয়ে রাখতে না পারে সেদিকে সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সজাগ থাকতে হবে। এটা করা হলে সমাজের প্রকৃত অভাবী মানুষজন উপকৃত হবে। করোনার সময়ে দেশের ব্যবসায়ী সমাজ এ ভালো কাজে এগিয়ে আসবে এটা সকলের প্রত্যাশা। এর ব্যত্যয় হলে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিবে- সরকারের প্রতি এটা সাধারণ মানুষের অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত প্রত্যাশা।

সবশেষে, করোনা আমাদের জন্য একটি পরীক্ষা। আমাদের এ পরীক্ষায় জিততে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করতে আসুন আমরা সবাই অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে যথাযথভাবে স্বাস্থ্য বিধি মেনে কোরবানি করি। রাজনৈতিকভাবে সচেতন স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন আন্তরিকভাবে তৎপর থাকলে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা দেশের সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপ সফল হবে এবং করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সমর্থ হবে।

আমাদের সকলেরই মনে রাখা উচিৎ, বেচে থাকলে অর্থ উপার্জন এবং ব্যবসা করার অনেক সুযোগ ভবিষ্যতে আসবে কিšদ করোনাকে জয় করায় ভূমিকা রাখার সুযোগ আর নাও আসতে পারে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত সমাজের কম আয়ের মানুষের কথা ভাবুন এবং তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসুন। আল্লাহ তাআলা নিশ্চয়ই আমাদের সহায় হবেন।

লেখকঃ অধ্যাপক ড. মোঃ সাইদুর রহমান, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ এবং পরিচালক, ইনস্টিটিউট অভ্ এগ্রিবিজনেস এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।