ব্যাঙ আর ব্যাংক : কে শুধিবে ঋণ?

প্রকাশিতঃ 12:10 am | January 06, 2018

মোস্তফা কামাল:
ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেয়াও এখন আভিজাত্য, হিম্মত এমন কি স্মার্টনেসের ব্যাপার। ক্ষমতাবান বলেই এমন ব্যক্তিত্বদের ঋণ পেতে সমস্যা হয় না। বরং তাদের টাকা পাইয়ে দিতে দিওয়ানা ব্যাংকের চেয়ারম্যান- এমডি থেকে শুরু করে দারোয়ান পর্যন্ত। দাতা-গ্রহীতা দুপক্ষের সমঝোতাতেই ঘটছে ঘটনা। কিন্তু কয়েক লাখ বড় জোর কোটি টাকা পেয়ে ব্যবসা করবেন, সুদাসলও ফেরত দেবেন– এমন কেউ ঋণ চাইলে কী দশায় পড়েন? জানেন ভুক্তভোগীরাই। কতো নিয়ম-কানুন তাদের জন্য! পুরো ব্যাপারটাই একদম ওপেনসিক্রেট।

ব্যাংকপাড়ায় অস্থিরতার খরস্রোতে পড়ার অন্যতম কারণ খেলাপি ঋণ। এক হিসাবে জানা গেছে, বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৩০ হাজার কোটি। এরমধ্যে অবলোপনের নামে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার হদিস নেই। টাকাতো আমানতকারীদের। তাদের টাকা এভাবে কাউকে দিয়ে দেয়া যায় কি-না, এ প্রশ্নের ধার ধারতে হচ্ছে না। এতে মুনাফায় ধস নামতে নামতে বেশ কটি ব্যাংকের অস্তিত্বেই টান পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কুলাতে পারছে না।

‘দেশের সকল ব্যাংকের কেন্দ্রশক্তি বাংলাদেশ ব্যাংকেই লুটপাট। ব্যাংকটিতে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়েছে। এর তদন্তও হয়েছে। কিন্তু ফলাফল কাউকে জানতে দেয়া হচ্ছে না।’

সরকারি ব্যাংকগুলোতে ৩০ শতাংশের মতো ঋণই খেলাপি। এই রোগে বেশি কাহিল নতুন প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকগুলো। এগুলোতে পরিচালকরা নিজেরা ভাগেযোগে খেলাপি হচ্ছেন। যাদের কয়েকজন বেশ নামকরা, চিহ্নিত। বিতর্কিত। বলতে গেলে তাদের কব্জাতেই পুরো ব্যাংকিং খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতেও ধরা পড়েছে এসবের কিছু তথ্য। বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগাতিতে বেশ মিলমহব্বত। নিজেরা এবং আপনজনদের ঋণ পাইয়ে দেয়ার ব্যাপারে সাম্য ও গণতন্ত্রের চর্চা করেন তারা। দেশে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক এখন ৫৭টি। কিছুদিনের মধ্যে তা ৬০-এ পৌঁছবে বলে শোনা যায়।

এসব ব্যাংকের পরিচালকরা নিজেরাই হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে রেখেছেন। আগে তারা অন্য ব্যাংকের টাকা মারতেন। এখন নিজেরা ব্যাংক করে জনগণের টাকা মারার লাইসেন্সধারী। এক তথ্যে জানা গেছে, ১৯টি ব্যাংকের পরিচালক নিজের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ৪০০ কোটি টাকার বেশি। একই ভাবে ৯টি ব্যাংকের পরিচালক গ্যারান্টার বা জিম্মাদার হয়ে ঋণ দিয়েছেন আরও ২৩১ কোটি টাকা।

গেল বছর কয়েকে সরকারি ব্যাংকে রাজনৈতিক নিয়োগের সঙ্গে দলবাজ-দলদাসদের ব্যাংকের মালিক বানানোর ধুম পড়েছে। তা ঋণের নামে টাকা মারা এবং অনিয়ম-জালিয়াতিতে নতুন মাত্রা এনেছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে সেরের ওপর সোয়া সের দেয়ার কারসাজিও। ঋণ অবলোপনের নামে কারসাজিটির ডালপালাও তরতাজা। এর মধ্য দিয়ে ব্যাংক লুট বা হাইজ্যাকের বদলে ব্যাংকের মালিক-মহাজন হবার নতুন ধারা তৈরি হলো।

এরমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক মাঝেমধ্যে খণ্ডিত নড়াচড়া দেয়। গর্জন করে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। নানান বাছবিচার ও ফির্টারিংয়ে বিচ্ছিন্ন সংবাদ আসে গণমাধ্যমে। এর যোগফলে কিছুটা বিচার-আচারের রিহার্সাল শুরু হয়েছে। আগে শুধু সর্বোচ্চ এমডি, ডিএমডি থেকে নিচেরদিকের কিছু ব্যাংকারকে সরানো হতো।

এখন খেদানোর লিস্টে চেয়ারম্যানও। ফার্মার্স ব্যাংকের চেযারম্যান মহীউদ্দিন খান আলমগীরের অপসারণের খবর মিইয়ে না যেতেই, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের (এনআরবিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দেওয়ান মুজিবর রহমানকে অপসারণ করা হয়েছে। অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ নিশ্চিত হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নেয়। আগামী দুই বছর তার কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যোগদানের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।

দেশের সকল ব্যাংকের কেন্দ্রশক্তি বাংলাদেশ ব্যাংকেই লুটপাট। ব্যাংকটিতে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়েছে। এর তদন্তও হয়েছে। কিন্তু ফলাফল কাউকে জানতে দেয়া হচ্ছে না। ব্যবস্থা নেয়া, না নেয়া নয়তো পরের ব্যাপার। ঘটনায় জড়িতদেরও চিনতেও দেয়া হচ্ছে না। বরং আড়াল করার যতো আয়োজন। জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থসম্পদের দায়িত্ব অনির্বাচিতদের হাতে। দায়িত্ব থাকলে কিছু কর্তব্য থাকতো। জবাবদিহিও থাকতো।

ফার্মাস ব্যাংকে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর একাই লোপাট করেননি। তার প্রশ্রয়ে দুর্নীতি উৎসবে শরীক হয়েছেন আরো অনেকে। এ কাজে তার খাস সাহাবা হিসেবে এসেছে তখনকার অডিট কমিটির চেয়ারম্যান বাবুল চিশতীর নাম। ঘুষ-কমিশনের বিনিময়ে তিনি ঋণ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন বিভিন্ন গ্রাহকদের। নিশ্চিতভাবে এগুলো পরিণত হয়েছে ব্যাড লোনে।

এদিকে, বিদেশে ১৬৫ কোটি টাকা পাচারের দায় স্বীকার করেছেন এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক। তবে, তিনি এতে জড়িত নন বলে জানান। টাকাটা পাচার করা হয়েছিল অফশোর কোম্পানি খোলার নামে। স্বীকারোক্তির সঙ্গে আশপাশের আরো কিছু তথ্যও বেরিয়ে আসে তার কাছ থেকে। কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, এ পাচারকর্মে জড়িত এমডিসহ ব্যাংকটির আরো কিছু কর্মকর্তা। বিদেশে অফশোর কোম্পানি খোলার নামে পানামা ও প্যারাডাইস কেলেঙ্কারির ঘটনার বাইরে এবি ব্যাংকের এই অর্থ পাচার।

জনগণের গচ্ছিত আমানত টাকা কোনো ব্যাংক এভাবে পাচার করতে পারে কি, পারে না? এ প্রশ্নের কাছে কিনারেও যাননি তারা। মন যা চেয়েছে করে ফেলেছেন। দুবাইভিত্তিক কোম্পানি পিজিএফ ৮০ মিলিয়ন ও এবি ব্যাংক ২০ মিলিয়ন ( ১৬৫ কোটি টাকা ) ডলার যৌথ বিনিয়োগে সিঙ্গাপুরে একটি অফশোর কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা বলা রয়েছে ব্যাংকের নথিপত্রে। এ কথা মতোই এবি ব্যাংক থেকে দুবাইতে পিজিএফের কাছে ১৬৫ কোটি টাকা পাঠানো হয়। পরে টাকাটা দুবাই থেকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়নি। অফশোর কোম্পানিও প্রতিষ্ঠা হয়নি।

ব্যাংকিং সেক্টরে অনিয়ম-জোচ্চুরিতে টেক্সটবুক দৃষ্টান্ত হিসেবে জায়গা করেছে বেসিক ব্যাংক। সেই কেলেংকারির প্রধান হোতা এরশাদ ও রওশানের স্নেহধন্য শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। ২০০৯ সালে হঠাৎ বেসিক ব্যাংকটির চেয়ারম্যান বনে যান তিনি। এর বছর কয়েকের মধ্যে ব্যাংকটির প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লুট। মিডিয়াতে তোলপাড়। দুদকে ডাকাডাকি।

বিপরীতে বাচ্চুর শান-মান আরো আলোকিত। তাকে রক্ষায় ব্যস্ত বহু মহাজন। এর আগে, হলমার্ক নামে সোনালী ব্যাংকে দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থ জালিয়াতির ঘটনা। সরকারি-বেসরকারি অন্য কয়েকটি ব্যাংকেও লুটপাটের উৎসব। বিশাল অংকের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিও বড় বড় ঘটনা তো রয়েছেই।

রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ, পরিচালনা পর্ষদে সরকারের পোষ্যদের নিয়োগের মধ্য দিয়ে তা এখন গা সহানোর যতো আয়োজন। তারওপর আরো নতুন ব্যাংক দেয়া-নেয়ার জার্নি চলছে। দেশে আর কোনো ব্যাংকের দরকার নেই বলা হলেও ভেতরে ভেতরে ঘটনা বেশ জোরালো। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকও নতুন ব্যাংকের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে। আইন অনুযায়ী ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকেরই। সেটাকে কেতাবে রেখে তিন কাজির গোয়ালে তিনটি নতুন ব্যাংকের জয়যাত্রা না-কি এখন সময়ের ব্যাপার।

আধিক্য বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত বোঝাতে বাংলায় ব্যাঙের ছাতাকে উপমা হিসেবে ব্যবহারের প্রচলন বেশ পুরনো। কিন্তু বাস্তবে ব্যাঙের ছাতার প্রতি এক ধরনের অবিচার। হালে ব্যাঙের ছাতা অমাবস্যার চাঁদের মতো। এর দেখা মেলে খুব কম। শহরে তো নয়ই। গ্রামেও খুব কম। এছাড়া ব্যাঙও বিলুপ্তির পথে। শিশুরা বই-পুস্তকে ব্যাঙের ছবি দেখে। ব্যাঙ বিষয়ে ছড়া, কবিতা পড়ে। কিন্তু জ্যান্ত ব্যাঙ দেখার সুযোগ হয় না সবার।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ব্যাঙের সংখ্যা কমে গেছে। গবেষকরা বলছেন পাঁচ প্রজাতির ব্যাঙ গত দুশ বছরে এমনিতেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কোলা ব্যাঙ, ভাউয়া ব্যাঙ, গাচ্ছা ব্যাঙ, ছাগল ডাকা ব্যাঙ, শুকর ডাকা ব্যাঙ, বামন ব্যাঙ, সবুজ ধানী ব্যাঙের নাম এখন শোনাও যায় না। ব্যাঙের ছানার মনের সুখে লাফানোর একটি ফুটেজ পেতে নানান জায়গায় দিনের পর দিন অপেক্ষার পরও ব্যর্থ হতে হয়।

ব্যাঙের শূন্যতায় এখন ব্যাংকের এ ছড়াছড়ি তথ্য বা খবর হিসেবে আমাদের জন্য সুখকর না ভয়ঙ্কর? সুবিধাভোগী ছাড়া বাকিদের জবাব বোধ হয় এক ও অভিন্নই হবে। এরমাঝেই ব্যাঙের বিলুপ্তি খুব অশুভ খবর। বলা হয়ে থাকে, ভূমিকম্প পূর্বাভাস দিয়ে হানা দেয় না। তবে ব্যাঙ তা জানে এবং জানার পর বিশেষ আওয়াজে সংকেত দেয়। বিজ্ঞানীরাও গবেষণায় এর সত্যতা পেয়েছেন।

বিজ্ঞানীদের আশা- ভবিষ্যতে প্রাণিকূলের আচরণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে হয়তো মানুষের পক্ষেও ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু, ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে দেশের অর্থ- সম্পদ লুট, চুরি, হ্যাক, জাল-জালিয়াতির তথ্য? তা থেকে জনগণকে অব্যাহতভাবে দূরেই রাখা হচ্ছে। সেই বোধবুদ্ধির দুয়ারও যে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে?

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

Print Friendly, PDF & Email