করোনায় লুপ্ত মানবিকতা জাগিয়ে তুলি

প্রকাশিতঃ 10:10 am | June 17, 2020

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম:

কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়ানোর পর থেকে মানুষের মধ্যে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। মানুষের আচরণের মধ্যে বেঁচে থাকার আকুতি বহুগুণ বেড়ে গেছে। একজন সুস্থ মানুষের মধ্যে যে আচরণ, সেই মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয়ে গেলে এবং সেই মানুষটি দুর্ভাগ্যক্রমে মৃত্যুবরণ করলে তার ওপর পরিবার তথা সমাজের অপরাপর মানুষের আচরণ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এক জটিল সমীকরণে রূপ নিয়েছে। কেউ বেঁচে থাকলে, রোগী হয়ে গেলে এবং মরে গেলে বিভিন্ন পর্যায়ে বর্তমানে যে সকল অমানবিক ঘটনা ও দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তার কিছু বর্ণনা এই নিবন্ধে তুলে ধরার প্রয়াস চালানো হয়েছে।

কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়ানোর পর থেকেই আতঙ্ক ছড়িয়েছে মানুষের মধ্যে। এই অতি-মহামারিতে নিজের ও পরিবারের সংক্রমণের আতঙ্ক, বাজারে পণ্য সংকটের আতঙ্ক, চাকরি হারানো বা দুর্ভিক্ষের আতঙ্ক, নানা কিছু। লকডাউনে মানুষের জন্য সবার ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। ভিক্ষুক ও দিনমজুরদের জন্য এই দরজা বন্ধ হওয়ায় যেন মৃত্যুকে ডেকে আনার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে। জানালা দিয়েও আর কেউ টাকা-পয়সা ছুঁড়ে দেয় না।

আমাদের দেশে ভিখারীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভাত চেয়ে ভিক্ষা করে। টাকা-পয়সা দিলেও একমুঠো খাবারের বায়না করে থাকে। তাদের অনেককেই থালা হাতে ঘুরতে দেখা যায়। দশ বাড়ি ঘুরলেই তাদের পেট ভরে যায়। লকডাউনের ফলে তাদের খাবার বন্ধ হয়ে গেছে। প্রথমদিকে অনেকে দয়াপরবশ হয়ে রান্না করা খাবারের প্যাকেট সরবরাহ করেছিলেন। খিচুড়ি রান্না করে লাইনে বসিয়ে দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু এখন করোনার ভয়াবহতায়, স্বাস্থ্যবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এবং সাহায্যের পরিমাণের তুলনায় সাহায্যপ্রার্থীর সংখ্যা ঢের বেশি হওয়ায় তৈরি খাবার প্রদান বন্ধ হয়ে গেছে।

অনেক সময় করোনার লক্ষণ দৃশ্যমান না থাকায় করোনা পজিটিভ ব্যক্তিকে দেখতে একদম সুস্থ মনে হয়। কারও করোনার উপসর্গ অন্য কেউ না জানা পর্যন্ত তার জন্য কোথাও তেমন কোনো সমস্যা নেই। কেউ সংক্রমিত হওয়ার লক্ষণ দেখেছে অথবা কেউ সংক্রমিত হয়ে পড়েছে এই খবর পাশের মানুষ জানতে পারলে হাজারো বিপত্তি শুরু হয়ে যায়। যদিও অন্যান্য রোগের চেয়ে এই রোগে কেউ আক্রান্ত হলে সেই সংবাদ যত দ্রুত সবাই জানতে পেরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেবে ততই মঙ্গল। তথাপি করোনারোগীকে যেন অপরাধী ভাবা হতে শুরু হয়ে যায়। তাকে একঘরে করা হয় সবার স্বার্থে।

কিন্তু আমাদের সমাজের কুসংস্কারের কারণে অনেকে এটাকে অভিশাপ, পাপের প্রায়শ্চিত্ত মনে করে। করোনারোগীকে খারাপ চোখে দেখা হয়, এড়িয়ে চলা শুরু হয়। একজন ডাক্তারের বাবা, যিনি নিজে একজন অতিরিক্ত সচিব ছিলেন, করোনাক্রান্ত হয়ে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছেন। তাকে হাসপাতলে নেয়া হলে কর্মীরা কেউ বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি আক্রান্ত হওয়ার আর সময় পেলেন না’, ইত্যাদি।

করোনারোগী দেখলেই সাধারণ মানুষের সন্দেহ, ভয় এবং ঘৃণা সেই রোগীকে বড় বেশি অসহায়, দুর্বল করে তোলে। এই অবস্থা বুঝতে পরে রোগীর মধ্যে চরম অপমান ও অপরাধবোধ সৃষ্টি হয়। যা তার বেঁচে থাকার পথে চিন্তা করতে বাধা দেয়। করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় রোগীকে অপরাধী বানানোর ফলে জীবনের প্রতি তার চরম ঘৃণা জন্মে। এছাড়া করোনা এমন এক মহামারি যার আক্রমণে চিকিৎসক, নার্স, পুলিশসহ সম্মুখ সারির যোদ্ধারা ব্যাপকভাবে প্রাণ হারানোর ফলে চিকিৎসা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ আস্থাহীনতায় ভুগছে। হাসপাতালে গেলে ভর্তির সুযোগহীনতা, অক্সিজেন না পাওয়া, ভেন্টিলেটর না পাওয়া, সেবা না পাওয়া ইত্যাদি তো রয়েছেই। সংক্রমণের হার দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় সবকিছু মিলে করোনারোগীর জন্য পরিস্থিতি বেশ বিপজ্জনক।

করোনায় হাসপাতালে কেউ মারা গেলে সেটা সবার জন্য বেশি বিপদ ডেকে আনে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাধারণ কেউ মারা গেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পর্যন্ত লাশবাহী গাড়িভাড়া পাঁচ হাজার টাকা। করোনায় মৃত রোগীর লাশ বহনের জন্য ভাড়া চাওয়া হয়েছে ১৩ হাজার টাকা। করোনারোগীর লাশ শোনা মাত্র ট্রলিবয় থেকে ডোম সবাই টাকা দাবি করে। লাশবাহী অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ সিন্ডিকেটের ভয়ে মানবিক সাহায্য দিতে এগিয়ে আসতে সাহস পায় না।

একজন করোনারোগীর আত্মীয় সেদিন কেঁদে-কেটে অস্থির। কারণ চাঁপাইয়ে লাশ নিতে তার পাঁচ হাজার টাকার বদলে লেগে গেছে ১৫ হাজার টাকা। এ যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। দেশের সব জায়গায় আঁতেল ও দালালদের দৌরাত্ম্য জনজীবনকে দুর্বিষহ করে চলেছে। এর যেন কোনো সমাধান নেই।

করোনায় মৃত রোগীর স্বজনরা ভয়ে পালিয়ে যায়। কেউ কাছে থাকলেও ছুঁয়ে দেখার সাহস ও সুযোগ থাকে না। অনেকে ভিডিওতে জানাজায় অংশ নেয়। কবর দেয়ারও কেউ নেই। শুধু বেসরকারি এনজিও-র দু-চারজন লোক। তারাও শুধু বড় শহরগুলোতে সীমাবদ্ধ। সারাদেশের অবস্থা খুব করুণ।

গত মাসে রংপুর শহরের এক লাশবাহী ড্রাইভারকে একজন গার্মেন্টস কর্মীর লাশ তার বাবার বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার জন্য পাঁচ হাজার টাকা চুক্তি করা হলেও সে অমানবিকভাবে রাতের আঁধারে লাশটিকে দ্বিতীয় তিস্তা সেতুর নিচে নদীর স্রোতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসেছিল। ক’দিন পর প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে ভাটিতে ভেসে আসা লাশটি উদ্ধারের পর সংবাদমাধ্যমে দেশবাসী সেই করুণ ঘটনা জানতে পেরেছে। এই ঘটনা অনেকে বিবেকে নাড়া দিয়েছে।

সিলেটের বিশ্বনাথে একজন অভিভাবক শহরে চাকরিস্থলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাড়ি গেলে তাকে ঘরের ভেতরে রেখে বাইরে থেকে ছিঁটকিনি আটকিয়ে রাখে তার পরিবার। ভয়ে কেউ তাকে রাতের খাবারও সরবরাহ করেনি। চিৎকার করে কোনো সাহায্য না পেয়ে তিনি মর্মান্তিকভাবে বন্ধ ঘরে মারা যান। তার দাফনে পরিবারের কেউ অংশ নেয়নি বলে জানা গেছে।

এছাড়া নিজ গ্রামের মানুষ করোনারোগী সন্দেহে মৃতকে দাফন করতে অহরহ বাধা দিচ্ছে। এই ধরনের ঘটনাকে শুধু কুসংস্কার বললে ভুল হবে। করোনাভীতি মানুষের দয়া-মায়া ও মানবিকতা কেড়ে নিয়ে পশুর স্তরে নামিয়ে এনেছে। করোনাকালের ভয়ংকর পরিবেশে মানুষের মানসিকতা অতি নিচু হয়ে গেছে, মানবিকতা লুপ্তপ্রায়। কেউ করোনায় মারা যাক বা না যাক এ সময় যে কেউ স্বাভাবিকভাবে মারা গেলেও সেই পরিবারের জন্য বিপদের ওপর বিপদ এসে হাজির হচ্ছে। সামাজিক নিয়ন্ত্রণহীনতা এই সময় গোটা দেশের পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে। এ থেকে বাঁচাতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সাহস ও আত্মপ্রচেষ্টা।

ক’দিন আগে সুপার সাইক্লোন আম্ফান বয়ে গেল, প্রতিদিন বজ্রপাত হচ্ছে, ভ্যাপসা গরমে নাভিশ্বাস শুরু হয়েছে। হচ্ছে, চারদিকে এত বিপর্যয়। এই সময় গতকাল মঙ্গলবার (১৬ জুন) ২৪ ঘণ্টায় দেশে সর্বোচ্চ ৩,৮৬২ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং মৃত্যুসংখ্যা ৫৩-তে পৌঁছে গেছে। এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হোক সেটা আমরা কেউ চাই না।

বিপদ যত গভীর হোক না কেন আমাদের হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। আসুন আমরা মনকে শক্ত করি। করোনারোগীকে ভয় না পেয়ে সাধ্যমতো মর্যাদার সাথে দাফনে সহযোগিতা করি। তাদের পরিবারকে সাহায্য করতে ও সমবেদনা জানাতে এগিয়ে আসি। করোনার ছুঁতোয় শুধু সন্দেহবশত কাউকে হেয় বা ঘৃণা না করি। পশুত্বে নেমে যাওয়া মানুষগুলোর মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলি- আর সবাইকে বলি বিপর্যয়ের এই ঘোর অমানিশায় ধৈর্য ধরুন। আলোয় রাঙা প্রভাত বেশি দূরে নয়। তাই করোনায় দিশেহারা হয়ে নিজ নিজ মানবিকতাকে আর লুপ্ত করবেন না।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। ই-মেইল : fakrul@ru.ac.bd

Print Friendly, PDF & Email