বাংলা নববর্ষ: উৎসের সন্ধানে

প্রকাশিতঃ 3:02 am | April 14, 2018

:: স্বপন ধর ::

নববর্ষ, নিউইয়ার বা নওরোজ, সমার্থক। ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর একই মহামাতৃধারা থেকে উৎসারিত বলেই হয়তো ‘ন’য়ে ‘ন’য়ের এমন দ্যোতনা। যার অর্থ নতুন বৎসর। ‘বৎসের’ সাথে র-প্রত্যয় যোগে বৎসর। বৎস অর্থ বালক। শব্দের মধ্যেই এই বালকত্ব বা নবীনত্বের পরিচয় মিলে (আসলে তা নতুন কী না তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে) ফরাসি একটি প্রবাদে বলা আছে ‘নুজা ভু সাজ তু সেলা’ অর্থাৎ There is nothing new Under the sun. পৃথিবীতে নতুন বলে কিছু নেই; যা আছে তা রূপান্তর মাত্র।

তবে প্রক্রিয়া চক্রটি নতুন পুরাতনের পালা বদলের মধ্য দিয়ে আমাদের চোখের সামনে ধরা দেয় আপেক্ষিক সূত্রে। কারণ আজ যা নতুন কাল তা পুরাতন। বহু প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের পর্যবেক্ষণে ধরা পরছে দিন ও রাত্রির এই ব্যবধান। দিন আসছে রাত যাচ্ছে; এমন পালাবদলের নিয়ম শৃঙ্খলাও ধরা পড়ে প্রাচীন বেদে। এই শৃঙ্খলার নাম দেয়া হয়েছে ঋত। তাঁদের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অমোঘ নিয়ম। সে নিয়ম একে অন্যের অধীন। যেমন নক্ষেত্রের অধীন গ্রহ। গ্রহের অধীন উপগ্রহ ইত্যাদি। কিন্তু সবকিছুর মূলে রয়েছে ঋত।

এই ঋত থেকেই ঋতুর উৎপত্তি হওয়া স্বাভাবিক। ঋত শব্দের মূলে আছে ঋ-ধাতুটি। যার মানে সর্বগম্য বা গতিশীল। ভারতের আর্যদের বলা হয় এই গতিশীল জাতি। এই ‘আর্যমূলেও’ আছে ঋ-ধাতু। আর্যগণ যাযাবর বা সর্বত্রগামী হওয়ায় ‘আর্য’অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছে। ঋ ধাতুর সাথে ক্ত প্রত্যয় যুক্ত হয়েছে নতুন শব্দ ঋত; যার আরেক অর্থ হ’ল পরম ব্রহ্ম। ক্তি প্রত্যয় যুক্ত হয়ে হয়েছে ঋতি। যার অর্থ গতি। তু প্রত্যয় যুক্ত হয়ে হয়েছে ঋতু। বেদে এর আরেক অর্থ ‘চরৈবেতী’। অর্থাৎ এগিয়ে চলা। বেদে দেবতাদের ঋতের অধীনে চলতে হয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঋতের আদেশে চলে। ঋত কথার তাৎপর্য তাই অনেক গভীর। পরবর্তী বেদগণকে ‘ঋত’ হারিয়ে যাচ্ছে, এমন আশঙ্কায় আশঙ্কিত হতে দেখা যায়। ঋত হারানো মানে শৃঙ্খলাকে হারানো। ঋত শব্দের সাথে ঋতুর একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক তাই অনুমান করাই যেতে পারে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই ঋতু রয়েছে; থাকাই সংগত।

ঋতু আসলে Physical order of the Universe. প্রকৃতির মধ্যে এ- ঋতুর বাহারি রূপ-ধর্ম এবং প্রভাব আমরা লক্ষ করি। প্রকৃতির মধ্য দিয়ে নারী জীবনেও এর সংযোগ দেখা যায়। সেই সংযোগও ঋতুর সংযোগ এবং সে ঋতুর উর্বরতা, প্রজনন এবং প্রবাহমানতার প্রতীক। প্রবাহমানতাই বস্তুকে ব্যক্তিকে নবীনতা উপহার দিতে পারে। নবীনতার মাধ্যমে শুরু হয়ে নববর্ষ বর্ষে বর্ষে বিভাজন সৃষ্টি করে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশে বারংবার প্রথম হবার সুযোগও গ্রহণ করে। নববর্ষ কে আমরা শুভ নববর্ষ বলি। ইংরেজিতে Happy New Year. এর কারণ সূচনা সবসময় শুভ দিয়েই হয়। ইংরেজদের জানুয়ারি নামটির মধ্যেও বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। জানুয়ারির মূলে রয়েছে ‘জানুস’ নামের এক দেবতা। যাকে বলা হয় ‘গড অব এনট্র্যান্স’ অর্থাৎ প্রবেশের দেবতা। ইংরেজদের নববর্ষের তাই রদবদল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু বাংলা এই নববর্ষ কালে কালে বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছিল। প্রথমে ছিল অগ্রহায়ণ। অগ্র মানে আগে, হায়ণ মানে বৎসর।

তার মানে দাঁড়াচ্ছে আগবর্ষ বা বর্ষশুরুর মাস এই অগ্রহায়ণ। কিন্তু কৃষি প্রধান দেশে এই অগ্রকে আমাদের পশচাতে ফেলতে হয়েছে। কারণ জলবায়ুর পরিবর্তনে ফসল তোলার সময়টা ছিল এর জন্য বিবেচ্য বিষয়। জলবায়ুর উপর নির্ভর করে এক সময় গুপ্তরা সংবৎ (৩১৯-৫১০খ্রি:) পালেরা (৭৫০-১১৫০খ্রি:) বঙ্গাব্দ, সেন আমলে শকাব্দ, ইত্যাদি প্রচলিত ছিল। মুসলিম আমলে শকাব্দ হিজরি সাল ধরে গণনা করা হয়। হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর মক্কা থেকে মদিনাতে হিজরতের কাল এটি। কিন্তু বঙ্গদেশে হিজরি সাল জনপ্রিয় হতে পারে নি। এর মূলেও ছিল কৃষি কর্ম, ফসল তোলা ইত্যাদি। সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রি: সিংহাসনে বসে (হিজরি ৯৬৩খ্রি:) নতুন এক ক্যালেন্ডার চালু করেন। চাষ বাস এবং কর আদায়ের সুবিধাকে সামনে রেখে এর প্রচলন করেন তিনি। ৯৬৩ হিজরি সালকেই তাই বাংলা প্রথম সাল হিসাবে ধরা হয়; এবং বাংলা ক্যালেন্ডারে অগ্রহায়ণ এবং হিজরি বা আরবি সালের চান্দ্র বছর পরিত্যাক্ত হয়। সেই সাথে মোহররম, সফর, রবিউল আওয়ালের পরিবর্তে চলে আসে সৌর সালের বিভিন্ন নক্ষত্র খচিত নাম। যেমন: বিশাখা নক্ষত্রের বৈশাখ, জ্যেষ্ঠার-জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়ার-আষাঢ়, শ্রবণার-শ্রাবণ, ভ্রদ্রার-ভাদ্র, অশ্বিনীর-আশ্বিন, কৃত্তিকার-কার্ত্তিক, পুষার-পৌষ, মঘার-মাঘ, ফাল্গুনির-ফালগুন, চিত্রার-চৈত্র। কেবল অগ্রহায়ণ কোনো নক্ষত্র থেকে আসেনি। এর নামকরণটি কেন হয়েছে তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। সৌর কালের বিশাখা নক্ষত্র যুক্ত অবস্থানে সূর্যের অবস্থান বলেই বৈশাখ। সেই বৈশাখ স্বশিক্ষিত মহান আকবরের হিসাব গণনার শুভসূচনার ফল। পশ্চিম আকাশে তখন ছায়াপথ আর কালপুরুষ; এবং তার নিচে লুব্ধকের উত্তরে ধ্র“বতারা এবং সপ্তর্ষিমণ্ডল, পূর্বে স্বাতী কন্যা আর তুলা রাশি। তুলা হল বৈশাখ মাসের নবতন নক্ষত্রমণ্ডলী।

এ সময়ে বিশাখা নামের নক্ষত্রটি দেখা যায় বলেই বিশাখা+ষ্ণ= বৈশাখ। ভারতীয় ক্যালেন্ডার এখনো শকাব্দকে মনে চলে। তাতে করে ভারতের প্রথম নববর্ষ চৈত্র মাসের এক তারিখ। কিন্তু এ তারিখ সর্বভারতে যে হয় নাই তা উড়িষ্যা, আসাম, পশ্চিম বাংলার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। পশ্চিমবাংলার আমজনতা; এবং প্রাদেশিক সরকার পহেলা বৈশাখকেই শুভ নববর্ষ হিসেবে পালন করে। সংস্কৃতি যে, রাষ্ট্রের কাঁটাতার দিয়ে তফাৎ করা যায় না; এটি বোধ হয় তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ কবি গুরুর এ সংগীতের তান এখন সকল বাঙালির প্রধান উজ্জীবনী মন্ত্র। তাই সন্দোহাতীত ভাবে আকবর প্রতিষ্ঠিত; এবং কবিগুরুর সমর্থিত আমবাঙালির প্রাণের অভিন্ন এই উৎস ধারার শুচিতার নাম বৈশাখ। বৈশাখ এলেই আমরা শুদ্ধ হবার প্রতিজ্ঞা নেই। এমন সার্বজনিন উৎসব বাঙালির আর একটিও নেই। বর্ষ পরিক্রমায় চৈত্রের পরেই বৈশাখ। ঋতুর রাজার প্রস্থানেই গ্রস্ ধাতুর গ্রীষ্ম। তার অর্থ গ্রাস করা। গ্রীষ্ম আসে সর্বগ্রাসী দৃষ্টি নিয়ে কালবৈশাখীর প্রতাপ; এবং সূর্যতাপের গভীর উষ্ণতা নিয়ে। বৈশাখ আসে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রজাতন্ত্রের প্রবল প্রতাপে। যেন এটি গণতন্ত্রের আধিপত্যের কথাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। স্মরণ করিয়ে দেয় সমাজতন্ত্রের কথাও। বিচ্ছিন্নতা থেকে সকলের ঐক্য এবং জরাগ্রস্থতাকে সরিয়ে মুমূর্ষুকে উড়ায়ে সে আসে নবীন।

আর তার প্রতীক্ষা করতে হয় না কারণ, শেলির ভাষায় “If Winter Comes, Can spring be far behind” এমন করে আমাদের পূর্ব পুরুষের নক্ষত্র খচিত বিভাজনে বৈশাখ, আসে ঋতু চক্রে অগ্রজ পুরুষরূপে- কবির কথায় বলা যায়-‘বর্ষ গেল বর্ষ গেল গ্রীষ্ম এলো বাড়ি। /পৃথ্বি এলো চক্র দিয়ে এক বছরের পাড়ি।’ এ চক্র ৩৬৫ দিনে বছর হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে। আর একটু পুরোনো কথা বলতেই হয়, তা হচ্ছে; সেই কবে নীল নদের তীরবর্তী মানুষ নদ-নদীর সর্বনাশা কীর্তির সময়কে চিহ্নিত করতে গিয়ে; এক ধ্রুবতারা থেকে আরেক ধ্রুবতারা উঠা পর্যন্ত হিসাব রাখতেন। এবং তা রাখতে গিয়ে বছরের হিসাবের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। সে হিসাব আজ বিজ্ঞানের যুগেও অনিবার্য। এ হিসাব শাশ্বত।

এ-হিসাবের সূত্র ধরেই বছরের জীবনের হালখাতা প্রতি বছর বাঙালির নববর্ষে বৈশাখে আসে। সাং-বৎসর হিসাবকে বাঙালি, তার জীবনে আজও অব্যাহত রেখেছে। ইংরেজি জানুয়ারির- ‘জানুস’ দেবতার হাত থেকে তার মুক্তি নেই জেনেও; পরম যত্নে চৈত্রকে সংক্রান্তি করে। সেই সাথে সংক্রমণও (সাঁকো) করে। নব প্রস্তুতির নব আবেগের, নব ভালোবাসার, মিলন মেলার মাসের নাম তাই প্রথম বৈশাখ। অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ। পাটশাক, ঘি দিয়ে ভাত খাওয়া; ইত্যাদি সরস খাবারের কথা সেই যে পাকৃতপৈঙ্গলে উল্লিখিত রয়েছে:

অগ্গর ভত্তা রম্বরা পত্তা
দুগ্ধ সজুত্তা গাইকা ঘৃত্যা
দুহিতা দুগ্ধা মোরলি মচ্ছা
নালিতা গচ্ছা রাঁধুনি রান্তা
খাই পুণবান্তা

অর্থাৎ গরম ভাতে গাইয়ের ঘি-দুধ, মলা মাছের ঝোল, নালিতা শাক, এমন দেশি বাহরি খাবার গৃহস্বামীকে পরম আদরে পত্নী পরিবেশন করে দিচ্ছেন। সে খাবার ইরানি পোলাও, মর্ডান ফাস্ট ফুড, বা কোকাকোলা কালচারে আজ পর্যন্ত যে থেমে যায়নি; তার মূল কারণ; সংস্কৃতি। বাঙালির সংস্কৃতি। বাঙালির এই সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের উৎসধারা উৎসুক ভাবে চিরকালই বাঙালি মন, প্রাণ দিয়ে আগলে রাখবে। বাংলা নববর্ষের উৎস সন্ধানে গেলে, এমন ভবিতব্যই আমাদের একমাত্র আশ্রয়। বাঙালি হয়ে বাংলার এ আশ্রয়কে আমাদের অস্তিত্বের স্বার্থেই প্রশ্রয় দিতে হবে। এমন প্রতিজ্ঞাই হোক; নববর্ষের নবশক্তির নব প্রেরণা।

লেখক: স্বপন ধর, বিভাগীয় প্রধান (বাংলা বিভাগ) ময়মনসিংহ কমার্স কলেজ ও নির্বাহী পরিচালক আই.এস.ডি.ডি

 

কালের আলো/ওএইচ

Print Friendly, PDF & Email